Thursday, March 28, 2013

তাকদীরের রহস্য

 তাকদীরের রহস্য

 

قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَاءُ بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ ﴿آل‌عمران: ٢٦

বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। (৩: ২৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: الْإِيْمَانُ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَبِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ، قَالَ جِبْرِيْلُ: صَدَقْتَ ঈমান হলো, আল্লাহ তাআলা, সমস্ত ফেরেশতা, আসমানী কিতাবসমূহ, সকল নবী-রাসূল, কিয়ামত দিবস এবং তাকদীরের ভালো-মন্দের  প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা।জিবরীল আ. বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। 

কোনো জিনিস অস্তিত্বে আসার আগেই আল্লাহ তাআলার সে সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া এবং ঐ জিনিসটি কিরূপে অস্তিত্ব লাভ করবে তা বিস্তারিত লিখে রাখার নাম তাকদীর। আর তাকদীর সংক্রান্ত একাজটি সম্পন্ন হয়েছে আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই।
তাকদীদের উপর ঈমান আনার ক্ষেত্রে একথাটিও মনে রাখতে হবে যে, সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহ তাআলার অধীনে এবং এগুলোর ক্ষেত্রে কেবল তাঁর ইচ্ছাই কার্যকরী হয়। সে হিসেবে তাকদীরে বিশ্বাসের অর্থ হবে: যেকোনো বিষয় সংঘটিত হওয়ার পূর্বে আল্লাহর চিরন্তন ইলমে তা রয়েছে, এ কথার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। এও বিশ্বাস করা যে, এ মহাবিশ্বে এমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, যা আল্লাহ তাআলার চিরন্তন ইলমের সীমার বাইরে ঘটছে। আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন ও  জেনেছেন, অতঃপর তাঁর চাওয়া ও জানা অনুযায়ী সকলকিছু ঘটছে এবং ঘটবে। 
তাকদীরে বিশ্বাস করার মধ্যে একথাও রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলের ভাগ্য, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই লাওহে মাহফুযে লিখে রেখেছেন।  সহীহ হাদীসে এ রকমই রয়েছে। আল কুরআনেও এ দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেإِنَّ ذَلِكَ فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ নিশ্চয় তা কিতাবে, আর তা আল্লাহর জন্য অতি সহজ’ (সূরা আল হজ: ৭০)
তাকদীরে বিশ্বাসের মধ্যে এ বিষয়টাও রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা যা চেয়েছেন  তা হয়েছে। আর যা চননি, তা হয়নি। এ পৃথিবীর সমগ্র মানুষ যদি একত্রিত হয়ে, আল্লাহ যা চাননি তা সংঘটিত করতে চায়, তবে তারা তা পারবে না। বরং কেবল তাই সংঘটিত হবে যা আল্লাহ চান, যা তিনি ইচ্ছা করেন। বান্দার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার আওতাধীন। ইরশাদ হয়েছে  :  وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا ، يُدْخِلُ مَنْ يَشَاءُ فِي رَحْمَتِهِ আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকে তোমরা অন্য কোনো অভিপ্রায় পোষণ করবে না। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তিনি যাকে ইচ্ছা তার রহমতে দাখিল করেন’ (সূরা দাহর: ৩০-৩১)
ইসলামে আকীদায়ে জবর অর্থাৎ মানুষ যা করছে আল্লাহ তাআলা তা করতে বাধ্য করেন, এ জাতীয় কোনো আকীদার স্থান নেই। প্রকাশ্যভাবে নেই, অপ্রকাশ্যভাবেও নেই। বরং ইসলামী শরীয়ত ও আকীদা অনুযায়ী  মানুষ স্বাধীন। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছায় ভালো ও মন্দের মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নেয়। যেকোনো একটি পথ বেছে নেয়। আল্লাহ তাআলা  ভালো ও মন্দ উভয়  পথই  পরিষ্কার করে বাতলে দিয়েছেন, দেখিয়ে দিয়েছেন।  যেমন ইরশাদ হয়েছে: وَهَدَيْنَاهُ النَّجْدَيْنِ আমি তাকে দুটি পথ প্রদর্শন করেছি’ (সূরা বালাদ: ১০)
 

তাকদীরের রহস্য সাধারনতঃ দূর্বোধ্য, তাই এ বিষয়ে জানার কৌতুহল অনেকেরই থাকতে পারে । আমি এ বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে সংক্ষিপ্ত কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করছি । যা কিছু আল্লাহ্ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত তাহাই তাকদীর । তাই আল্লাহ্ পাকের সমগ্র সৃষ্টিই তাকদীরের বিধান অনুযায়ী হয়েছে । এই তাকদীরের বিধান আল্লাহ্ পাকের জারীকৃত দুইটি সুস্পষ্ট বিধান দ্বারা সীমিত । তার একটি হল আল্লাহ্ পাকের এখতিয়ারাধীন সৃষ্টিগত আইন যাকে ইসলামের পরিভাষায় তাকবিনী আইন বলে । তাকবিনী বলিতে সৃষ্টিগত কাজের ধারাবাহিক নিয়ম কানুনকে বুঝায় । যেমন “কুন” বলার সঙ্গে সঙ্গে “ফাইয়াকুন” হয়েছে । অর্থাৎ মহাবিশ্ব সৃষ্টি হইয়াছে এবং সৃষ্টির পর তাহা নিখুঁতভাবে কেয়ামত পর্যন্ত চলিতে থাকিবে ।
ইরশাদ হয়েছে: قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا. وَقَدْ خَابَ مَنْ دَسَّاهَا .যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করল সে সফল হলো। আর যে নিজেকে কলুষিত করল সে ব্যর্থ হলো’ (সূরা শাম: ৯-১০)
কোনো কিছু সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার পূর্ব-অবগতি এবং পূর্ব থেকে লিখে রাখা কোনো অর্থেই বান্দাকে বাধ্য করা নয়। বরং এর অর্থ হলো কোনো কিছু হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা আগে থেকেই জানেন এবং তা হবে বলেই তিনি তা  লিখে রেখেছেন। বরং তা বান্দার উপর হুজ্জত বা প্রমাণ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং এ জন্য যে, আল্লাহ তাআলার সুপরিব্যাপ্ত ইলমের বাইরে  কোনো কিছুই ঘটেনা, কখনো ঘটবেও না।
অপরটি হল মানুষের এখতিয়ারাধীন বাস্তব জীবন যাপনের জন্য কাজ যাকে ইসলামের পরিভাষায় তাশরিয়া আইন বলে । এইটি মানুষের ইচ্ছার স্বাতন্ত্র্য ও কর্মের স্বাধীনতার মধ্যে সীমিত । তাকদীরের বিধান অনুযায়ী তাশরিয়া কাজটি করিলে এই ফল দাঁড়াইবে, আর না করিলে এই ফল দাঁড়াইবে এইরূপ । এক্ষেত্রে যে বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থায় কাজটি করা আর না করার ফলাফল ঝুলন্ত বা অচূড়ান্ত অবস্থায় তাকদীরে লিপিবদ্ধ থাকে সেই ব্যবস্থাকে তাকদীরে মুয়াল্লাক বলে ।
আবার তাকদীরে মুয়াল্লাকে রক্ষিত কাজটির ফলাফল আদৌ ঘটিবে কি ঘটিবেনা তাহা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া পূর্ব হইতে কেউই জানেননা । এমনকি ফেরেশতারাও তাহা জানেননা । এই চূড়ান্ত ব্যবস্থাকে তাকদীরে মুবরাম বলে । তবে তাকদীর আল্লাহ্ কর্তৃক একবার মুবরাম বা চূড়ান্ত হলে তাহা কখনও রদবদল হয়না । তাকদীরে মুয়াল্লাক এবং তাকদীরে মুবরাম উভয়ের মধ্যকার সময়ের পরিসরটিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় কতিপয় ভাগ্য বিপর্যয় উত্তরণের সুযোগ রহিয়াছে । আর কতিপয় ভাগ্য বিপর্যয় যাহা আল্লাহ্ কর্তৃক মুবরাম বা চূড়ান্ত তাহার উত্তরণ সম্ভব নয় ।
যে কারনে দেখাযায়, মানুষ চেষ্টার দ্বারা অনেক সময় সফল হয়, আবার কখনো আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় । যেহেতু সৃষ্টিজগতের কেউই তাকদীরে মুবরাম সম্পর্কে জানিনা সেহেতু সকল ব্যাপারে সচেষ্ট থাকাই উচিত । চরম চেষ্টা সাধনা নামে অভিহিত তদবীরই একমাত্র প্রক্রিয়া যাহা ভাগ্য বিড়ম্বিতকে সৌভাগ্যে উত্তরণ ঘটাইতে সক্ষম ।
এ সম্পর্কে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁহার এক হাদীসে বলেছেন, “তদবীরই তাকদীরের নিয়ামক ।” অন্যত্র বলেছেন, “চেষ্টা সাধনা কখনও বৃথা যায়না ।” পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ্ পাক ঘোষনা করেন, “আল্লাহ্ কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেননা যতক্ষণ না সেই জাতি নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে ।” পবিত্র কোরআন শরীফে আল্লাহ্ পাক আরও বলেন, “মানুষ যাহা চেষ্টা করে তাহার অতিরিক্ত কিছুই তাহার প্রাপ্য নয় ।”
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي كَبَدٍ [٩٠:٤]  
নিশ্চয় আমি মানুষকে শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি। সুরা-৯০/৪
উপরোল্লিখিত আলোচনার আলোকে বলাযায়, বস্তুতঃ কর্মের প্রভাব অনস্বীকার্য । এ কথা ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য । সাবধানতা, ধৈর্য্য, সংযম, নিয়মানুবর্তিতা, আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা, কর্মস্পৃহা, প্রচেষ্টা, সাহায্য গ্রহন, চিকিৎসা ইত্যাদিও তদবীরের সমার্থক যা তাকদীরে মুয়াল্লাকের বিষয় । এক্ষেত্রে দেখাযাচ্ছে ব্যক্তিই তার ভাগ্যের তথা তাকদীরে মুয়াল্লাকের নিয়ন্ত্রক থাকছেন । অনিবার্য নিয়তী বা তাকদীরে মুবরাম যাহাই থাক । আর সেজন্যই মানুষ সবসময় তার ভাগ্যকে সৌভাগ্যে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টাই করে যায়, ইহাই মানুষের ইতিহাস ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মানুষ যে আমল করে এবং কষ্ট স্বীকার করে সে ব্যাপারে আপনার কী অভিমত? এ ব্যাপারে কি কলম শুকিয়ে গেছে এবং আমলনামা গুটিয়ে ফেলা হয়েছে? নাকি তারা যা করছে  নতুনভাবে  করছে?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাবে বললেন, ‘এ ব্যাপারে কলম শুকিয়ে গেছে এবং আমলনামা গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে আমল করে লাভ কি
জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আমল করতে থাকো। আর প্রত্যেকের জন্য ঐ আমল করা সহজ হবে যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে’ (বুখারী)
 আল্লাহ তাআলা সবকিছু জানেন এবং তিনি যা জানেন তাই লিখে রেখেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা লিখে রেখেছেন যে, অমুক ব্যক্তি ঈমান আনবে এবং নেক-কাজ করবে। ফলে সে জান্নাতে যাবে। আবার আরেক ব্যক্তি সম্পর্কে লিখে রেখেছেন যে, সে গুনাহের কাজ করবে এবং জাহান্নামে যাবে। অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলা জানেন বলে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, অমুক ব্যক্তি একটি মেয়েকে বিয়ে করবে এবং তার সাথে সহবাস করবে। ফলে তার সন্তান হবে এবং আরেক ব্যক্তি সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, সে আহার করবে এবং তৃপ্ত হবে। এমতাবস্থায় কেউ যদি একথা বলে যে, আমি যদি জান্নাতী হই তবে তো আমার আমলের কোনো প্রয়োজন নেই, আমল ছাড়াই আমি জান্নাতে যেতে পারব; তাহলে তার একথা বাতিল বলে সাব্যস্ত হবে। কেননা সে জানে যে, সে তার নেক-আমল দ্বারা জান্নাতে যাবে। এখন যদি সে আমল ছাড়া জান্নাতে দাখেল হয় তাহলে তা আল্লাহ তাআলা যা জানেন এবং তিনি যা ফয়সালা করে রেখেছেন তার বিরোধী হবে।
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْم، أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ

0 comments:

Post a Comment

 
Copyright © . A-Tasauf is the holy place of Mind . - Posts · Comments
Theme Template by BTDesigner · Powered by Blogger