তসাউফের প্রথম ধাপ তাওবা
হাদীসে আছে যে তাওবা করী এমন যার কোন গুনাহ বাঁকী থাকেনা।
”আপনার পালনকর্তা জানেন, আপনি এবাদতের জন্যে দন্ডায়মান হন রাত্রির প্রায়
দু’তৃতীয়াংশ, অর্ধাংশ ও তৃতীয়াংশ এবং আপনার সঙ্গীদের একটি দলও দন্ডায়মান হয়। আল্লাহ
দিবা ও রাত্রি পরিমাপ করেন। তিনি জানেন, তোমরা এর পূর্ণ হিসাব রাখতে পার না। অতএব
তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমা পরায়ন হয়েছেন। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে
সহজ, ততটুকু আবৃত্তি কর। তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হবে, কেউ কেউ
আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশে-বিদেশে যাবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে জেহাদে লিপ্ত
হবে। কাজেই কোরআনের যতটুকু তোমাদের জন্যে সহজ ততটুকু আবৃত্তি কর। তোমরা নামায
কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্যে যা কিছু
অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে।
তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (৭৩: ২০) ”
আল্লাহ তাআলার দরবারে
বান্দার তাওবা করা অধিক পছন্দনীয়। মানুষ অপরাধ করার পর আল্লাহ তাআলার নিকট
তাওবা করা ও গুনাহের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করাকে তিনি অত্যধিক পছন্দ করেন।
আল্লাহ তাআলা তাওবা কবুল করেন এবং তাওবার মাধ্যমে বান্দাকে পুত পবিত্র
করেন। তবে তাওবা কি বা তাওবা কবুল হওয়ার জন্য শর্তাবলী কি তা আমাদের জানা
থাকা জরুরি। তাই নিম্নে এ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ আলোচনা তুলে ধরা হল।
তাওবা কাকে বলে?
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ
وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ
بِخُمُرِهِنَّ عَلَىٰ جُيُوبِهِنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا
لِبُعُولَتِهِنَّ أَوْ آبَائِهِنَّ أَوْ آبَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ أَبْنَائِهِنَّ
أَوْ أَبْنَاءِ بُعُولَتِهِنَّ أَوْ إِخْوَانِهِنَّ أَوْ بَنِي إِخْوَانِهِنَّ أَوْ
بَنِي أَخَوَاتِهِنَّ أَوْ نِسَائِهِنَّ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُنَّ أَوِ
التَّابِعِينَ غَيْرِ أُولِي الْإِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ أَوِ الطِّفْلِ الَّذِينَ
لَمْ يَظْهَرُوا عَلَىٰ عَوْرَاتِ النِّسَاءِ وَلَا يَضْرِبْنَ بِأَرْجُلِهِنَّ
لِيُعْلَمَ مَا يُخْفِينَ مِن زِينَتِهِنَّ وَتُوبُوا
إِلَى اللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ﴿النور: ٣١﴾
ঈমানদার
নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত
করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং
তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা,
শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক
অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ
সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন
তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা
সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (২৪: ৩১)
খারাপ কাজ-গুনাহ, পাপচার, অন্যায় অবিচার ও
আল্লাহর নাফরমানি হতে ফিরে এসে, বান্দা নেক কাজ করার মাধ্যমে তার প্রভুর
দিকে ফিরে আসাকে তাওবা বলা হয়। অনেক অজ্ঞ বা মূর্খ লোকেরা মনে করে তাওবা
শুধু মাত্র খারাপ কাজ বা গুনাহের কাজ থেকে ফিরে আসার দ্বারাই হয়ে থাকে।
তাদের এ ধরনের ধারণা মোটেও ঠিক না। বরং, এখানে সঠিক, নির্ভুল ও গ্রহণযোগ্য
কথা হল, যে সব নেক আমল করার জন্য আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন তা ছেড়ে
দেয়াও গুনাহ। যারা এ সব নেক আমলগুলো পালন করা ছেড়ে দেয় তাদের অবশ্যই তা
ছেড়ে দেয়া হতে তাওবা করা এবং ফিরে আসা, নিষিদ্ধ কাজ করা থেকে তাওবা করা হতে
আরো বেশী গুরুত্বপুর্ণ।
অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর অনেক আদেশ, অন্তরের
কার্যাদি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমল বা যিকির ছেড়ে দেয়, অথচ তারা জানেই না যে
এগুলো সবই আল্লাহর আদেশের অন্তর্ভুক্ত এবং এ গুলো ছেড়ে দেয়া বা এ সব আমল
পালন করা হতে বিরত থাকা অপরাধ ও গুনাহ। অথবা জানা থাকলেও তারা তার পাবন্দি
করে না। এবং এগুলো ছেড়ে দেয়াতে যে, তার পাপ হচ্ছে, তা থেকে ফিরে আসা ও
তাওবা করা যে গুরুত্বপূর্ণ বা অতীব জরুরী তা তারা বিশ্বাস করে না। ফলে
সত্যিকার জ্ঞান না থাকার কারণে তারা হয়ত পথভ্রষ্টদের দলভুক্ত হয় অথবা
অভিশপ্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। সত্যকে সত্য বলে জানা সত্ত্বেও তা হতে
বিরত থেকে তারা মন্দ পরিণতির অধিকারীই রয়ে গেল।
وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَانًا حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهًا
وَوَضَعَتْهُ كُرْهًا وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا حَتَّىٰ إِذَا
بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِينَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ
أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَىٰ وَالِدَيَّ وَأَنْ
أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِي فِي ذُرِّيَّتِي إِنِّي تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ﴿الأحقاف: ١٥﴾
আমি
মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্টসহকারে
গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্টসহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার স্তন্য
ছাড়তে লেগেছে ত্রিশ মাস। অবশেষে সে যখন শক্তি-সামর্থে?480; বয়সে ও চল্লিশ বছরে
পৌছেছে, তখন বলতে লাগল, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে এরূপ ভাগ্য দান কর, যাতে আমি
তোমার নেয়ামতের শোকর করি, যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে
আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকাজ করি। আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কর, আমি তোমার প্রতি
তওবা করলাম এবং আমি আজ্ঞাবহদের অন্যতম। (৪৬:
১৫)
কোন মানুষই অপরাধ ও ত্রুটিমুক্ত নয়। আর
সমস্ত আদম সন্তানই ভূলের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। আর উত্তম ব্যক্তি হল
আল্লাহর কাছে তওবাকারী। আর মহান আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের মাধ্যমে এবং মহানবী
(সা.) হাদীসের মাধ্যমে গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করার প্রতি
উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে :
]قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ
مِثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ
فَاسْتَقِيمُوا إِلَيْهِ وَاسْتَغْفِرُوهُ[(فصلت: من الآية6)
অর্থাৎ, হে রাসূল আপনি বলুন নিশ্চয় আমি
তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার নিকট ওহী (প্রত্যাদেশ) পাঠানো হয়। আর নিশ্চয়ই
তোমাদের ইলাহ একজন মাত্র। তোমরা তাঁর পথেই স্থির ও সুদৃঢ় থাক এবং তারই
কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। আল্লাহ আরো বলেন :
]وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعاً أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ[(النور: من الآية31)
অর্থাৎ হে মুমিনগণ তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর কাছে তওবা কর। আশা করা যায় তোমরা সফল হতে পারবে।
উল্লেখিত আয়াতটি মদীনায় অবর্তীণ হয়েছে এ
আয়াতে আল্লাহ তায়ালা শুধু ঈমানদার নয় বরং তখনকার সময়ের সবচেয়ে উত্তম মাখলুক
যারা জিহাদ, সবর, হিজরতসহ যাবতীয় নেক কাজে কিয়ামত পর্যন্তের জন্য ইতিহাস
হয়ে থাকবেন, তাদেরকে তাওবা করার নির্দেশ দেন এবং তারপর তিনি তাওবাকে সফলতা ও
কামিয়াবী লাভের কারণ নির্ধারণ করেন। সুতরাং, কামিয়াবী বা সফলতা পাওয়ার
একমাত্র উপায় হল আল্লাহর নিকট খালেস তাওবা করা। আল্লাহর দরবারে তাওবা করা ও
যাবতীয় গুনাহ হতে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া কোন ঈমানদারই সফল হতে পারে না।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
]يَا أَيُّهَا الَّذِينَ
آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحاً عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ
يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ
تَحْتِهَا الْأَنْهَار[(التحريم: من الآية8)
অর্থাৎ ওহে যারা ঈমান এনেছ তোমরা তোমাদের
রবের নিকটে একনিষ্ঠতার সাথে কবুলযোগ্য তওবা কর। আশা করা যায়, তোমাদের রব
তোমাদের থেকে সকল গুনাহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ
করাবেন যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
]إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ[(البقرة: من الآية222)
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং তিনি পবিত্রা অর্জনকারীদেরকেও ভালবাসেন।
আম্মার ইবন ইয়াসার (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি
বলেন যে, ‘নবী করীম (সা.) বলেন যে : ‘‘হে মানবজাতি তোমরা আল্লাহর কাছে
তওবা কর এবং আমি প্রতিদিনে একশতবার তওবা করে থাকি।’’ (মুসলিম)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে,
তিনি বলেন আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন যে : ‘‘নিশ্চয় আমি
আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তার কাছে দৈনিক সত্তরবারের বেশী তওবা
করি।’’ (বুখারী)
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে,
রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘‘আল্লাহ তার বান্দাহর তওবার কারণ খুব খুশি হন। যখন
বান্দাহ তার কাছে তওবা করে তখন বান্দাহ যে অবস্থায় থাকুক না কেন আল্লাহ তার
ডাকে সাড়া দেন।’’
আর আনাস এবং ইবন আব্বাস (রা.) থেকে
বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূল (সা.) বলেন যে : ‘‘যদি আদম সন্তানের জন্য স্বর্ণ
দ্বারা নির্মিত উপত্যকাও হয় তার পরেও তার কাছে দুটি স্বর্ণের উপত্যকা হওয়া
ভাল মনে করবে। তারপরও তার মুখ কখনো পূর্ণ হবেনা। তবে মাটি দ্বারা পূর্ণ
হবে। আর আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক তওবাকারীকেই ক্ষমা করে দেন।’’ (বুখারী ও
মুসলিম)
অতঃপর তওবা হল আল্লাহর অবাধ্যচারণ থেকে
ফিরে গিয়ে আল্লাহর আনুগত্য পথের দিকে ধাবিত হওয়া। কেননা আল্লাহ হলেন প্রকত
ইবাদত পাবার যোগ্য। আর প্রকৃত ইবাদত হল মাবুদের জন্য তার প্রেম ভালবাসায় ও
মহত্বের বিনয়ী হওয়া। আর দ্রুত তওবা করা আবশ্যক। বিলম্ব করা কোনক্রমেই বৈধ
নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রাসূল (সা.) তওবা করার জন্য নির্দেশ
দিয়েছেন। আর তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সকল নির্দেশই দ্রুত দ্রুততার সাথে
সাথে পালন করা উচিৎ। কেননা বান্দাহ জানেনা যে, বিলম্বে কোন কাজ করলে তা কি
অর্জন করা যাবে কি-না? কেননা হঠাৎ তার মৃত্যু এসে পড়তে পারে। অতঃপর সে তওবা
করার সুযোগ পাবে না। আর অন্যায় কাজ বারবার করার মাধ্যমে অন্তর কঠিন হয়ে
যায় এবং আল্লাহর হুকুম পালনে দূরত্বে অবস্থান করে। আর তার ঈমান দূর্বল হয়ে
যায়। কেননা ঈমান আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় এবং অন্যায় করার
মাধ্যমে ঈমান কমে যায়। কেননা বারবার অপরাধ করার দ্বারা অপরাধ করার প্রতি
মানসিকতা তৈরী হয়। আর যখন কোন আত্মা কোন বস্তুর প্রতি সীমালংঘন করে ফেলে
তখন তার থেকে পৃথক হওয়া কঠিন হয়ে যায়। এবং তখন তার উপর শয়তান বিজয়ী হয়ে
বসে। আর অন্যান্য বড়বড় অপরাধ করার প্রতি অনুপ্রেরণা যোগায়। এ জন্যইতো
ওলামায়ে কেরাম বলে থাকেন যে, নিশ্চয় সকল ধরণের অপরাধ কুফুরী বৃদ্ধি করে।
ফলে মানুষ ধাপে ধাপে একটি অপরাধ থেকে আরেকটি অপরাধে লিপ্ত হয়ে যায়। এমনকি
সে দ্বীন থেকে দূরে সরে চলে যায়।
মোট কথা, তাওবা বান্দার জীবনের শেষ ও শুরু। তবে তার প্রয়োজন যেমনিভাবে জীবনের শেষাংশে জরুরী অনুরূপভাবে জীবনের প্রথমাংশেও জরুরী।
তাওবাতুন নাছুহা কি?
التَّائِبُونَ الْعَابِدُونَ الْحَامِدُونَ السَّائِحُونَ الرَّاكِعُونَ السَّاجِدُونَ الْآمِرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّاهُونَ عَنِ الْمُنكَرِ وَالْحَافِظُونَ لِحُدُودِ اللَّهِ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ ﴿التوبة: ١١٢﴾
তারা
তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোযার, (দুনিয়ার সাথে) সম্পর্কচ্ছেদকারী, রুকু ও সিজদা
আদায়কারী, সৎকাজের আদেশ দানকারী ও মন্দ কাজ থেকে নিবৃতকারী এবং আল্লাহর দেওয়া
সীমাসমূহের হেফাযতকারী। বস্তুতঃ সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে। (৯: ১১২)
মনে রাখতে হবে তাওবা হল মানুষের অন্তরের
প্রচেষ্টা। অর্থাৎ, মানুষের অন্তরে অপরাধবোধ জাগ্রত হওয়া এবং নিজেকে
গুনাহের কারণে অপরাধী মনে করা যা বান্দার অন্তরে কখনো কখনো জাগ্রত হয়ে
থাকে। অন্তরে এ ধরনের অনুভূতি জাগ্রত হওয়ার অর্থই হল তাওবা বা ক্ষমা
প্রার্থনা ও আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া। আর আত্মাকে সকল প্রকার গুনাহ,
অন্যায়, পাপাচার ইত্যাদি হতে বিরত রাখার মাধ্যমে একজন বান্দা সফলকাম হতে
পারে।
জনৈক আলেম তাওবার সংজ্ঞায় বলেন, আল্লাহর
অসোন্তোষ ও পাকড়াওয়ের ভয়ে গুনাহের ইচ্ছা ছেড়ে দেয়া এবং সমপর্যায়ের যে সব
গুনাহ তার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তার থেকে ফিরে এসে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা
প্রার্থনা করা। শুধু সংঘটিত গুনাহ নয়, যদি কোন গুনাহের ইচ্ছা মনে জাগ্রত
হয়ে থাকে তা থেকে ফিরে আসাও এক ধরনের তাওবা। মনে রাখতে হবে তাওবা শুধু
করলেই কবুল হয়ে যায় না। মুখে ক্ষমা প্রার্থনা দ্বারাই আল্লাহ তাআলা ক্ষমা
করে দেন না। তাওবা কবুল হওয়া বা শুদ্ধ হওয়া জন্য একাধিক শর্ত রয়েছে।
শর্তগুলো পূরণ করা তাওবা কবুল হওয়া পূর্ব শর্ত। এ শর্তগুলোর বাস্তাবায়ন
ছাড়া তা কবুল হয় না।
তাওবা কবুলের জন্য পাঁচটি শর্ত
পাপের সম্পর্ক যদি আল্লাহর সাথে হয়,
তাহলে তা থেকে তওবা করতে হলে তার মাঝে তিনটি শর্ত বিদ্যমান থাকতে হবে। আর
পাপের সম্পর্ক যদি মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করার সাথে সম্পর্কীয় হয় তবে সে
পাপ থেকে তওবা করতে হলে তার মাঝে ৪টি শর্ত বিদ্যমান থাকতে হবে। তাহলে বুঝা
গেল, তাওবার শর্ত তিনটি বা চারটি। কিন্তু চুল-চেরা বিশ্লেষণ করলে তাওবার
শর্ত হয় মোট ৫টি।
প্রথম শর্ত : তাওবাটি
এখলাসের সাথে হতে হবে। কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তাওবা হতে
হবে। লোক দেখানো বা মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হলে হবে না। আল্লাহর
সন্তুষ্টি, আখেরাত লাভ এবং আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পাবার আশায় তাওবা করতে
হবে।
তওবা একনিষ্ঠতার সাথে হওয়া চাই এবং
আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ও তার মহত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং তাঁর
কাছে কল্যাণের আশা করা এবং তাঁর শাস্তি থেকে ভয় পাওয়া। এ তওবা দ্বারা
পার্থিব কোন বস্তু কামনা অথবা কোন সৃষ্টজীবের কাছে কিছু প্রার্থনা না করা
চাই। আর যদি কেউ এমনটি করে তাহলে তার তওবা কবুল হবে না। কেননা সে অসৎ
উদ্দেশ্য নিয়ে তওবা করেছে। সে আল্লাহর কাছে তওবা করেনি এবং সে একটা
নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে তওবা করেছে।
দ্বিতীয় শর্ত : কৃত
পাপকর্মের প্রতি আন্তরিকভাবে লজ্জিত বা অনুতপ্ত হতে হবে। কৃত কর্মের প্রতি
অনুতপ্ত এবং মর্মাহত হতে হবে। তাওবার সাথে সাথে যদি লজ্জিত হয়, তাহলে বুঝা
যাবে যে, লোকটি সত্যি সত্যি তাওবা করেছে।
তার পুর্বকৃত গুনাহর জন্য লজ্জিত ও হীন
হওয়া চাই এবং সে এই আশা করবে যে, তার এই তওবা কবুল না হলে সে কিছুই অর্জন
করতে পারবে না। আর তার এই তওবা হবে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়া এবং তার কৃত
অপরাধের শাস্তির ভয় স্মরণ করা। তাহলে তার তওবা হবে একান্ত বিশ্বাসের সাথে
এবং চাক্ষুষের সাথে।
তৃতীয় শর্ত : পাপের
কারণে যার অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে, তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। এবং
ভবিষ্যতে আর এ পাপকর্মে লিপ্ত হবেনা বলে দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। পাপকর্মটি
যদি ফরজ বা ওয়াজিব লঙ্ঘণ সংক্রান্ত হয়, তবে সাথে সাথে তাতে ফিরে যেতে
হবে। যেমন: কোন ব্যক্তি যাকাত আদায় করেনি। এখন সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে
যাকাত আদায় করতে চায়, তাহলে শুধু তাওবা করার দ্বারা তার অতিতের
অনাদায়কৃত যাকাতগুলো ক্ষমা হয়ে যাবে না। প্রথমে অতিতের অনাদায়কৃত
যাকাতগুলো আদায় করতে হবে। তাহলেই বুঝা যাবে যে, সে আন্তরিকভাবে তাওবা
করেছে এবং তাওবার প্রতি সত্যিই শ্রদ্ধাশীল।
অতি তাড়াতাড়ি গুণাহের কাজ থেকে দূরে সরে
যাওয়া। কেননা নিষিদ্ধ কাজ দ্বারা যদি অপরাধ হয়ে যায় তাহলে সে উহার মধ্যে
ধাবিত হবে। আর তার অপরাধ যদি কোন আবশ্যকীয় কাজ বর্জনের মাধ্যমে হয় তাহলে তা
অবশ্যই সাথে সাথে করে নিবে। যতটুকু সম্ভব সাথে সাথে পূরণ করে নিবে। যেমন
যাকাত ও হ্জ্জ।
যদি পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে থাকে, তাহলে
শুধু তাওবা করার দ্বারাই তা কবুল হবে না। সাথে সাথে তাদের প্রতি যত্নবান
হয়ে তাদের সেবায় নিজেকে মগ্ন করে তাওবার সত্যতা প্রমাণ করতে হবে।
কেউ যদি আত্নিয়তার বন্ধন ছিন্ন করে থাকে,
তাহলে শুধু তাওবা করার দ্বারাই তার তাওবা কবুল হবে না। বরং আত্নিয়দের
সাথে ছিন্ন বন্ধন থেকে বেরিয়ে এসে তাদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তুলে তাওবার
সত্যতা প্রমান করতে হবে। তাহলেই কেবল তার এ তাওবা কবুল হবে।
কেউ যদি হারাম কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে,
তাহলে তাওবার সাথে সাথে তা থেকে ফিরে আসতে হবে। যেমন, কোন ব্যক্তি সুধের
ব্যবসায় নিজেকে জড়িয়েছে। এখন তা থেকে তাওবা করতে হলে শুধু মুখে তাওবা
করলাম বললেই যথেষ্ট হবে না। বরং সাথে সাথে তা থেকে ফিরে এসে, তা থেকে
উপার্জিত অর্থ ফেরৎ বা ছওয়াবের নিয়ত ছাড়াই গরীব মিসকিনদের মাঝে
বিলি-বন্টন করে দিয়ে তাওবার প্রতি যে শ্রদ্ধাশীল তা প্রমান করতে হবে।
তাহলেই কেবল তার এতাওবা কবুল হবে।
কেউ যদি কারো আমানতের খেয়ানত করে থাকে,
তাহলে শুধু তাওবা করলেই যথেষ্ট হবেনা। সাথে সাথে তার আমানত ফিরিয়ে দিতে
হবে। কেউ যদি কারো গীবত করে থাকে তাহলে তার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে নিতে হবে।
যার গীবত করা হয়েছে তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে যে
সভায় বা মজলিসে বা যাদের সামনে তার গীবত করা হয়েছে সে মজলিসে বা তাদের
সামনে তার কোন গুণ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। ওলামাগণ বলেন যে, এর
দ্বারাও গীবত থেকে তাওবার সত্যতা প্রমাণিত হবে।
আর কোন ব্যক্তি বারবর কোন অপরাধ করার
দ্বারা তওবা করায় কোন লাভ নেই। ধরা যাক, কেউ সুদ খাওয়া থেকে তওবার করল অথচ
সে সুদের কাজে কর্মে সর্বদা ব্যস্ত থাকে তাহলে তার এই ধরণের তওবা করার
দ্বারা কোন লাভ হবে না। বরং তার তওবা হবে হাসি-ঠাট্টা ও বিদ্রুপ করার
ন্যায়। বরং এর দ্বারা সে আল্লাহর তার আয়াতসমূহের সাথে অবজ্ঞা আচরণ করল। এর
দ্বারা তাকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। আবার যদি কেউ তওবা করে যে,
জামাতের সাথে নামাজ পড়া আর কখনো ত্যাগ করবে না, অথচ সর্বদা সে জামাতে
নামায ত্যাগ করে চলে, তাহলে তার এই তওবা করার দ্বারা কোন লাভ হবে না।
আর যখন সৃষ্টজীবের অধিকারের সাথে
সংশ্লিষ্ট কোন ব্যাপারে অপরাধ করে বসে তখন সৃষ্টজীবের অধিকার আদায় না করা
পর্যন্ত তার তওবা সঠিক হবে না। আর যখন কোন ব্যক্তি অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে
হস্তগত করে অথবা কারো সম্পদ নিয়ে আবার অস্বীকার করে তাহলে উক্ত ব্যক্তির
সম্পদ ফিরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত তওবা সঠিক হবে না। আর যদি ইতিমধ্যে উক্ত
সম্পদের মালিক আরো পায় তাহলে তার উত্তরাধিকারীদের কাছে ফিরিয়ে দিবে। আর যদি
তার কোন উত্তরাধিকারী জীবিত না থাকে তাহলে বাইতুল মালে আদায় করে দিবে। আর
যদি এমন হয় যে, কোন ব্যক্তি এই হস্তগত সম্পদের মালিক না পায় তাহলে উক্ত
সম্পদশীল ব্যক্তির নামে সাদকাহ করে দিব।
আর যদি কোন মুসলিমকে গীবত করার দ্বারা
অপরাধ ঘটে যায় তাহলে উক্ত গীবত থেকে মুক্ত থাকা আবশ্যক হয়ে যায়। আর কোন
অপরাধ বারবার করার পরও তওবা করা সঠিক হবে। কেননা আমল কোন কোন সময় কম হয়ে
থাকে। আর ঈমান (তওবা) বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
চতুর্থ শর্ত : ভবিষ্যতে
আর এপাপকর্মে লিপ্ত হবেনা বলে দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। এটা হল তাওবার
শর্তগুলোর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত। সুতরাং কেউ যদি তাওবা করার
সময় এ নিয়ত করে যে, এখন এ পাপ থেকে বিরত থেকে তাওবা করলাম। তবে সুযোগ
পেলে আবারো করব। তাহলে তার তাওবা কবুল হবেনা। কোন ব্যক্তির অঢেল টাকা-পয়সা
আছে, মদ-জুওয়ার রমরমা ব্যবসা করে। কোন একসময় তার অর্থ সংকট হয়ে পড়ে।
এখন যদি সে তাওবা করে যে, আমি আর এগুলোর ব্যবসা করব না, কিন্তু মনে মনে
থাকে যে, আবারো টাকা-পয়সা হাতে এলে নতুনভাবে এ ব্যবসা শুরু করব। তাহলে তার
এ তাওবা কবুল হবেনা। টাকা-পয়সা না থাকার কারণে এখন সে ইচ্ছা করলেও উক্ত
হারাম ব্যবসা করতে পারছে না, তাই এ জাতীয় তাওবাকে বলা হয় তাওবায়ে “আযেজ”
অর্থাৎ অক্ষম তাওবা। আর এ তাওবা তাওবাকারীর কোন কাজে আসে না। তাই পাপ করার
সামর্থ থাকাকালীন সময়টা হল তাওবার উপযুক্ত সময়। পাপ করার ক্ষমতা লোপ
পেয়ে গেলে তখন তাওবা করা যথোপযুক্ত নয়।
এ ধরণের সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই ধরণের
অপরাধ ভবিষ্যতে আর কখনো করবে না। কেননা ইহা তওবার ফল এবং তওবাকারীর জন্য
একটা সত্যতার দলিল। যদি কেউ বলে যে, নিশ্চয় সে তওবা করছে এবং সুদৃঢ়
সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কখনো করবে না অথবা তওবা করেছে এই নিয়তে যে, সে বারবার
এই কাজ করবে আবার তওবা করবে তাহলে তার তওবা কবূলযোগ্য হবে না। কেননা তাহলে
তার এই তওবা হবে সাময়িক যা দ্বারা তার কোন প্রকার দ্বীন ও দুনিয়ার উপকার
আসবে না।
পঞ্চম শর্ত : এমন সময়ে
তাওবা করতে হবে, যেসময়ে তাওবা কবুল হওয়ার ব্যপারে ঘোষনা রয়েছে।
[মুসলিম-৪৮৭২, রিয়া: ১৭] আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাঃ
বলেছেন :
مَنْ تاب قَبْلَ أَنْ تطلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مغْرِبِهَا تَابَ الله علَيْه
যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে সুর্য উদয়ের
পূর্ব পর্যন্ত তাওবা করবে আল্লাহ তাআলা তার তাওবা কবুল করে নিবেন। তেমনি
ভাবে [মুসনাদু আহমদ-৫৮৮৫, রিয়া: ১৮]
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন:
إِنَّ الله عزَّ وجَلَّ يقْبَلُ توْبة العبْدِ مَالَم يُغرْغرِ
অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তার বান্দার তাওবা
কবুল করেন তার মৃত্যুর লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত। তাই মৃত্যুর আলামত
প্রকাশ পাওয়ার পর তাওবা করার আর সুযোগ থাকেনা। মানুষ যখন তার জীবনের শেষ
মুহুর্তে অবস্থান করে, বেঁচে থাকার আর কোন সম্ভাবনা দেখেনা তখন কেবল তাওবা
করে এজাতীয় তাওবাকে বলা হয় (তাওবায়ে “এযতেরার”) আর তাওবায়ে “এযতেরার”
তাওবাকারীর কোন কাজে আসেনা। আল্লাহ তাআলা সুরায়ে নিসার ১৮ নাম্বার আয়াতে
বলেন :
وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ
لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّىٰ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ
الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ
كُفَّارٌ ۚ أُولَٰئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
আর এমন লোকদের জন্য কোন ক্ষমা নেই, যারা
মন্দ কাজ করতেই থাকে। এমনকি যখন তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু উপস্থিত হয়,
তখন বলতে থাকে: আমি এখন তাওবা করছি। আর তাওবা নেই তাদের জন্য যারা কুফরী
অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। আমি তাদের জন্য যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির ব্যবস্থা
রেখেছি। তাই সুস্থ জীবনই তাওবার উপযুক্ত সময়। জীবন থেকে নিরাশ হওয়ার পর
তাওবার উপযুক্ত সময় আর থাকে না। আল্লাহ তাআলা সুরাতুল মু’মিনের ৮৩ এবং ৮৪
নাম্বার আয়াতে বলেন :
فَلَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا
قَالُوا آمَنَّا بِاللهِ وَحْدَهُ وَكَفَرْنَا بِمَا كُنَّا بِهِ
مُشْرِكِينَ [৮৪] فَلَمْ يَكُ يَنْفَعُهُمْ إِيمَانُهُمْ لَمَّا رَأَوْا
بَأْسَنَا
তারা যখন আমার শাস্তি প্রত্যক্ষ করল,তখন
বলল: আমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। এবং যাদেরকে শরীক করতাম
তাদেরকে পরিহার করলাম। অতঃপর তাদের ঈমান তাদের কোন কাজেই আসলনা, যখন তারা
শাস্তি প্রত্যক্ষ করল।
তওবার কবুলের সময় শেষ হবার পর আর কখনো
গুনাহর কাজ করবে না। কেননা যদি তওবা কবূলের সময় শেষ হবার পর আবারও উক্ত
গুনাহ করে তবে তার তওবা কবূল হবে না। আর তওবা কবূলের সময় হওয়া দু‘-ধরণের।
একটি হলো ব্যাপকভাবে প্রত্যেকের জন্য। আর দ্বিতীয়টি হল প্রত্যেকটি ব্যক্তির
নিজস্বতার জন্য। সাধারণভাবে : আর উহা হল পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয় হওয়া।
আর পশ্চিম দিকে সূর্য যখন উদিত হবে তখন আর তওবার করার দ্বারা কোন উপকার হবে
না। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে,
]يَوْمَ يَأْتِيَ بَعْضُ آيَاتِ
رَبِّكَ يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لا يَنْفَعُ نَفْساً
إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ
كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْراً[ (الأنعام: من الآية158)
كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْراً[ (الأنعام: من الآية158)
অর্থাৎ, তখন আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেকটি
অন্তকরণে মোহর মেরে দিবেন এবং মানুষের আমল করার সুযোগ শেষ হয়ে যাবে। নবী
করীম (সা.) আরো বলেন যে, যে ব্যক্তি সূ্র্য্ পশ্চিম দিক উদয় হবার পূর্ব সময়
পর্যন্ত তওবা করবে তার তওবা আল্লাহ কবুল করবেন।(মুসলিম)
বিশেষভাবে : প্রত্যেকটি ব্যক্তির মৃত্যুর
সময় উপস্থিত হলে। কেননা মৃত্যুর সময় হাযির হয়ে গেলে তার আর তওবা কবুলের সময়
থাকে না। ফলে তওবা করলেও কোন লাভ হবে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে,
]وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ
لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ
الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآن [ (النساء: من الآية18)
অর্থাৎ আর তাদের তওবা কোন কাজে আসবে না
যারা খারাপ আমল করে যতক্ষণ না তাদের নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়। আর
মৃত্যুকালীন সময়ে বলে যে, আমি এখন তওবা করলাম।
আব্দুল্লাহ ইবন ওমর (রা.) হতে বর্ণিত তিনি
বলেন যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বান্দাহর তওবা কবুল
করে থাকেন যতক্ষণ না তার রুহ অবশিষ্ট থাকে। (তিরমিযী)
আর যখনই সব শর্তানযায়ী তওবা করা হয় তখন
তওবা কবূল করা হয় এবং আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা বড় ধরণের অপরাধও ক্ষমা করে
দিবেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
]قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ
أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ
اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعاً إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ[
(الزمر:53)
অর্থাৎ যহ রাসূল আপনি বলে দিন যে, হে আমার
বান্দাহরা যারা নিজেদের আত্মার উপর অত্যাচার করেছ, তোমরা কখনোই আল্লাহর
রহমত হতাশ হয়ে যেওনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সব গুনাহকে ক্ষমা করে দিবেন।
কেননা তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল ও দয়ালু।
এই আয়াতটি আল্লাহর দিকে সাড়াদানকারী ও তওবাকারী ব্যক্তিদেরকে মুসলিম বলে প্রমাণ করে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন -
]وَمَنْ يَعْمَلْ سُوءاً أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُوراً رَحِيماً[
(النساء:110)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন খারাপ আমল করে অথবা
নিজের প্রতি অত্যাচার করে এরপর ক্ষমা প্রার্থনা করে না। এর পরেও সে
আল্লাহকে অতিশয় ক্ষমাশীল ও দয়ালু হিসেবে পাবে।
আল্লাহর নিকট প্রার্থনা হলো, আল্লাহ যেন
আমাদের ক্ষমা করেন এবং আমাদেরকে তাওবা করার তাওফীক দান করেন। আর আমাদের
মধ্যে যারা আল্লাহর দরবারে তাওবা করেন তাদের তওবা যেন তিনি কবুল করেন।
তাওবার ফলাফল:
ইমাম গাজালী রহ. তার কিতাব মিনহাজুল
আবেদীনে’ লিখেন “অতপর হে! ইবাদতকারী তোমার উপর কর্তব্য হল তুমি আল্লাহর
নিকট তাওবা কর । আর তাওবা করবে তুমি দুইটি কারণে,
এক :
তাওবার কারণে আল্লাহ তোমাকে তার আনুগত্য
করা সহজ করে দিবেন এবং তোমার নেক কাজ করার তাওফীক ও সৌভাগ্য লাভ হবে।
গুনাহের পরিণতি হল, গুনাহ মানুষকে বঞ্চিত করার অভিবাকত্ব করে এবং লাঞ্ছনা ও
বঞ্চনার দিকে ঠেলে দেয়। গুনাহতে আবদ্ধ লোককে আল্লাহর আনুগত্যের পথে চলা ও
আল্লাহর দীনের খেদমতে অগ্রসর হতে গুনাহ বারণ করে। গুনাহের বোঝা ভারি হলে
সকল প্রকার নেক আমল তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তার জন্য আর কোন নেক আমল করা
সহজ হয় না ইবাদত বন্দেগীতে সে আর কোন উৎসাহ পায় না। আর সব চেয়ে বিপদজনক কথা
হল, যারা সব সময় গুনাহে লিপ্ত থাকে তাদের অন্তর কালো হয়ে যায়, ফলে তারা
অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। অন্তর ভাল মন্দের বিচার করতে অক্ষম হয়ে যায়, তাদের
অন্তর পাথরের চেয়েও শক্ত হয়ে যায়। ফলে কোন ভাল কাজ তার অন্তর কবুল করে না।
তখন একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া সে আর
কোন মুক্তি বা নাজাতের পথ খুজে পায় না। কোন কিছুতেই তৃপ্তি অনুভব করে না।
সে নিজেকে অনিরাপদ মতে করে। নিজের জন্য কোথাও নিরাপদ স্থান খুঁজে পায় না
এবং পায় না কোন আশ্রয় কেন্দ্র। পরিণতিতে ধাবিত হয় গভীর অন্ধকার ও ভয়ঙ্কর
বিপদের দিকে। ধীরে ধীরে গুনাহ তাকে ঈমান হারা হওয়া এবং শিরক ও কুফরের দিকে
টেনে নিয়ে যায়।
আরো আশ্চযের্র বিষয় হল, যে ব্যক্তি
র্দুভাগা এবং যার অন্তর পাথরের চেয়েও বেশী কঠিন, তাকে কিভাবে আল্লাহর
আনুগত্যের তাওফীক দেয়া হবে ? তাকে কিভাবে আহবান করা হবে কল্যাণের পথে ? অথচ
সে গুনাহের কাজেই অবিচল, তার মধ্যে কোন অনুভূতি নাই। সে যে একজন অপরাধী ও
অন্যায়কারী এ বিষয়ে তার মধ্যে কোন চেতনা জাগ্রত হয় না। সুতরাং তাকে কিভাবে
কাছে আনা হবে যে নাপাকী ও র্দূগন্ধময় বস্তুর সাথে সর্বদা মাখামাখি করছে,
গুনাহের কাজে লিপ্ত থাকে অহর্নিশ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম বলেন : মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে,তার মুখ থেকে র্দূগন্ধ বের হতে
থাকে, আর সাথে সাথে তার কাছ থেকে দুই জন ফেরেশতা দূরে সরে যায়। তখন আর তার
মুখ ও জিহবা আল্লাহর যিকিরের উপযোগী থাকে না
ফলে গুনাহে লিপ্ত থাকে এ ধরনের খুব কম
লোকই আছে যারা পরর্বতীতে আল্লাহর আনুগত্যে ফিরে আসে এবং আল্লাহর ইবাদতে কোন
স্বাদ আস্বাদন করে। যদি সে কোন দান-সদকা করে তা অনেক কষ্টে, এতে কোন স্বাদ
উপভোগ করে না, আত্মার কোন তৃপ্তি হয় না এগুলো সবই হল গুনাহের পরিণতি এবং
তাওবা না করার ফলাফল।
জৈনক লোক সত্য কথাই বলছেন, যদি তুমি দিনে
রোজা এবং রাতে ইবাদত করতে না পার, তাহলে মনে রাখবে তুমি একজন হাতে পায়ে কড়া
পরিহিত শিকলাবদ্ধ লোক। তোমার গুনাহই তোমাকে এ পরিণতিতে টেনে এনেছে।
দুই :
আর দ্বিতীয় বিষয় হল, তোমাকে যে কারণে
আল্লাহর নিকট তাওবা করতে হবে তা হল, যাতে আল্লাহ তোমার ইবাদত বন্দেগীগুলো
কবুল করেন। কারণ, পাওনাদার সাধারণত উপঢৌকন গ্রহণ করে না। গুনাহ হতে বিরত
থাকা, গুনাহ হতে তাওবা করা এবং প্রতিপালককে সন্তুষ্ট করা হল ফরজ কাজ। আর
অন্যান্য সকল ইবাদত তা সবই নফল। সুতরাং, মূল পাওনা পরিশোধ ছাড়া আল্লাহ
তাআলা তোমার থেকে কিভাবে উপঢৌকন গ্রহণ করবেন? তুমি কীভাবে তার সন্তুষ্টি
লাভের উদ্দেশ্যে বৈধ ও মুবাহ কাজা গুলি ছেড়ে দিবে অথচ তুমি এখনো আল্লাহর
নাফরমানী এবং নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত। তুমি কিভাবে আল্লাহকে ডাকবে, তার সাথে
মুনাজাত করবে এবং তার প্রশংসা করবে অথচ আল্লাহ তোমার উপর রাগান্বিত। মনে
রাখতে হবে যারা আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত তাদের অবস্থা উল্লেখিত অবস্থার
মোটেই ব্যতিক্রম নয়, তারা আল্লাহর অবাদ্ধতায় লিপ্ত অথচ তারা আল্লাহর নিকট
দোয়া করে, আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করে এবং তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে।
0 comments:
Post a Comment