Thursday, March 28, 2013

রেনেসাঁর ইকবাল কবি

রেনেসাঁর ইকবাল কবি

পাঠক ! আপনারা পাকিস্তানের বিখ্যাত কবি ইকবাল লাহোরীর নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। আল্লামা ইকবাল উর্দু,ফার্সি বিচিত্র ভাষায় কবিতা লিখেছেন। তো এ আসরে আমরা কবি ইকবাল,তাঁর কবিতা বা লেখালেখি এবং তাঁর দর্শনের সাথে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। সেইসাথে ইকবাল এবং ইরানের ইসলামী দর্শন,ইকবাল এবং মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রভৃতি বিষয়েও কথা বলার চেষ্টা করবো। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।

এখনো ঘাসের পরে দেখি না বন্ধু কোনো
আমিই বসন্তের প্রথম পুষ্প যেন
পানপাত্রে তাকালে দেখি শুধু নিজেকেই
এ ভাবনায় যদি অন্য কাউকে পেয়ে যাই
জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে যে তুলি নির্দ্ধিধায়
লিখেছে সে এক বার্তা এ জীবনের রঙীন পাতায়

কবি ইকবাল লাহোরী ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ই নভেম্বরে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটে জন্মগ্রহণ করেন। ইরানের বিখ্যাত গবেষক প্রফেসর ফারিদানীর মতে বহু যুগ পরে ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদেরকে অলস-নিদ্রা থেকে জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। ইকবালের বাবা নূর মোহাম্মাদ ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি জ্ঞানী-গুণীদের আসরে বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আলাপ-আলোচনা করতে ভালোবাসতেন। তাঁর কর্মক্ষেত্র একটা শিক্ষাকেন্দ্রে পরিনত হয়েছিল। ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি যাদের অনুরাগ ছিল তাদের অনেকেই সেখানে সমবেত হতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করতেন। তিনি পবিত্র চরিত্রের অধিকারী ছিলেন এবং কোরআন তেলাওয়াতকে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের উপায় বলে মনে করতেন। তিনি তাঁর ছেলে ইকবালকে উপদেশ দিয়ে বলতেন যে, কোরআন এমনভাবে পড়ো যেন আল্লাহর সাথে কথা বলছো।

ইকবালের মাও ছিলেন একজন পুণ্যবতী এবং দ্বীনদার রমনী। এ ধরনের একটি পরিবারে কবি ইকবাল লালিত পালিত হন,বেড়ে ওঠেন। ফলে তাকওয়ার শিক্ষা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের শিক্ষা তিনি নিজ পরিবারেই লাভ করেন। একেবারে ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁর পারিবারিক পরিবেশে ইরানী বিখ্যাত মরমী কবি সানাঈ, আত্তার, ইরাকী, জামি, হাফেজ, মৌলাভি এবং সাদি'র কবিতার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পান। শৈশবকালীন বা প্রাথমিক শিক্ষা তিনি তাঁর জন্মস্থান পাঞ্জাবের শিয়ালকোটেই অর্জন করেন। সেখানেই তিনি কোরআন শেখেন,পড়তেও শেখেন,লিখতেও শেখেন। পড়ালেখার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের প্রথম পর্ব শেষ করেই তিনি শিয়ালকোটের স্কট্স মিশন কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে তিনি প্রচলিত জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি,ফার্সি এবং আরবি ভাষাও শেখেন।

শামসুল উলামা নামে খ্যাত মৌলভি সাইয়্যেদ হাসানের কাছে তিনি ফার্সি এবং আরবি ভাষা ছাড়াও উর্দু সাহিত্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান অর্জন করেন। শামসুল উলামা ছিলেন তাঁর বাবার বন্ধু। তাঁর সাহচর্যে ইকবাল কবিতা সম্পর্কে এতোই ভালো ধারণা অর্জন করেন যে মাত্র ১৯/২০ বছর বয়সেই তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর সেই যুবক বয়সের কবিতাও অগ্রজ উর্দু কবি সাহিত্যিকদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। তাঁরা ইকবালের কবিতার প্রশংসা করেন।
ইকবালের চিন্তা-চেতনা ছিল ব্যবসায়িক চিন্তার অনেক উর্ধ্বে। তাই তিনি বাবার ব্যবসায়িক উত্তরাধিকার না হয়ে চলে গেলেন লাহোরে,শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে। প্রফেসর ফারিদানীর মতে-‘তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ভারতীয় মুসলমানদের জন্যে তাঁর ওপর এমন এক গুরুদায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে যে,তাঁর উচিত ঐ দায়িত্ব সাফল্যের সাথে পালন করা।' তিনি শিয়ালকোটকে এই কাজের জন্যে ক্ষুদ্র মনে করলেন,তাই লাহোরে চলে গেলেন এবং সেখানকার সরকারী কলেজে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ. অর্জনের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন।

ইসলাম গবেষক প্রফেসর টমাস আর্নল্ডের কাছে তিনি এবার শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে গেলেন। দর্শনের ব্যাপারে কবি ইকবালের সৃষ্টিশীলতা,প্রেম এবং চিন্তার উৎকর্ষ এতো গভীর ছিল যে, স্বয়ং তাঁর শিক্ষক আর্নল্ড এক সময় বলেছিলেন-‘এই ছাত্র, শিক্ষককে গবেষক এবং গবেষককে মহাপণ্ডিত বানিয়ে ছাড়বে।' ১৯০৫ সালে ইকবাল ইংল্যান্ডে যান এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যান। সেখানে ইরান বিশেষজ্ঞ দুই জন মধ্যপ্রাচ্যবিদের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। একজন হলেন এডওয়ার্ড ব্রাউন এবং অপরজন হলেন নিকলসন। এই দুই শিক্ষকের সাথে উঠাবসার সুবাদে ফার্সি সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর ভালো একটা ধারণা জন্মে। ফার্সি কবিতা পাঠের জন্যেও তাঁর কণ্ঠ পরিপক্ক হয় এবং সম্ভবত এ সময়টাতেই তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তাচেতনা প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার প্রেরণা পান। যাই হোক, ইকবাল এখানে দর্শন এবং আইনশাস্ত্রে পড়ালেখা শেষ করে দর্শনের ওপর পড়ালেখা চূড়ান্তভাবে শেষ করার জন্যে জার্মানীতে যান।

ইউরোপে কয়েক বছর কাটানোর ফলে ইকবাল প্লেটো থেকে বার্গ সঁ পর্যন্ত বিভিন্ন দার্শনিকের চিন্তা ও কর্মের সাথে পরিচিত হন। তবে পাশ্চাত্য দর্শন তাঁকে তুষ্ট করতে পারে নি। কেননা পাশ্চাত্য দর্শনে তিনি সমাধান-অযোগ্য বহু বিষয় দেখতে পেয়েছেন। এ সময় তিনি পাশ্চাত্যের দার্শনিক মতবাদগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেন এবং তাঁর নিজস্ব চিন্তাদর্শ অর্থাৎ ইসলামী আদর্শকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন অগ্রগতি বা দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করার সুযোগ পান। এই প্রচেষ্টারই সোনালী ফসল হলো "দ্য ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পারসিয়া" বা পারস্যে অধিবিদ্যার উন্নয়ন নামক গ্রন্থটি। এটি ছিল তাঁর একটি গবেষণাপত্র। এই গবেষণাপত্র বা থিসিসটি তিনি জমা দিয়েছিলেন মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে। ঐ ইউনিভার্সিটি তাঁকে এই থিসিসের জন্যে দর্শনে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছিল। থিসিসটি প্রকাশিত হয় লন্ডনে। সেই থেকে ইকবাল ইউরোপীয় সাহিত্যিক , রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী মহলে প্রাচ্যের একজন দার্শনিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন।

ইকবাল তাঁর এই থিসিস বা অভিসন্দর্ভটি তৈরী করার প্রয়োজনে বহু ফার্সি বই তাঁকে পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে আধ্যাত্মিকতা,দর্শন,নীতি-নৈতিকতা প্রভৃতি বিষয়ে তিনি ফার্সি অনেক বই পড়েছেন। আর এসব বই পড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ফার্সি ভাষার সাথে তাঁর পরিচয়টা নিবীড় হয়েছে। এরপর তিনি ফার্সি ভাষার বই-পুস্তক প্রায় নিয়মিতই পড়তেন। এই পড়ালেখা বা পরিচিতির প্রভাবে যা হয়েছে তাহলো,তাঁর আধ্যাত্মিকতা বা দার্শনিক চিন্তা প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষাটা উপযোগী হয়ে উঠেছিল। এ জন্যেই লক্ষ্য করা গেছে যে,কবি ইকবাল তাঁর বহু বই ফার্সি ভাষায় লিখেছেন।

লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া এবং আরবি ভাষার শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পর কবি ইকবাল লাহোরে ফিরে যান এবং লাহোর কলেজে দর্শনের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কিছুদিন পর অর্থাৎ ১৯১১ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি যেমন প্রচুর লেখালেখি করেন,তেমনি প্রচুর পড়াশোনাও করেন। মামলা সংক্রান্ত ফাইলপত্রাদি এবং আইন নিয়েও পড়াশোনা করেন। ফলে বাধ্য হয়েই তাঁর দেশের রাজনৈতিক সমস্যা ও সঙ্কট নিয়ে তাঁকে লড়তে হয়। এভাবে তিনি ভারত ,ইউরোপ এবং আমেরিকায় খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। ১৯২৬ সালে তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমান প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন।১৯৩০ সালে মুসলিম লীগের বার্ষিক সভার সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রস্তাব ওঠে। ১৯৩৩ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। তারপর থেকেই শুরু হয় ইকবাল জবিনের কষ্টকর অধ্যায়। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন তিনি। ঐ সাদামাটা জীবনযাপনের মধ্য দিয়েই ১৯৩৮ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়।

রেনেসাঁর কবি ইকবাল ( ২ )


পাঠক ! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি আপনারা ভালো ও সুস্থ আছেন। গত আসরে আমরা অত্যন্ত সংক্ষেপে আল্লামা ইকবালের জন্ম এবং মৃত্যুর ইতিহাস সম্পর্কে বলেছিলাম। আজকের আসরে আমরা তাঁর ফার্সি ভাষায় লেখা মূল্যবান কিছু সাহিত্যের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। কবি ইকবালের লেখালেখির ওপর আলোচনায় আপনারা সঙ্গ দিতে ভুলবেন না-এ প্রত্যাশায় শুরু করছি রেনেসাঁর কবি ইকবাল শীর্ষক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের আজকের পর্ব।

আল্লামা ইকবাল উর্দুভাষা, ইংরেজি ভাষা এবং ফার্সি ভাষায় প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তবে ফার্সি ভাষায় যা লিখেছেন তার সবই কবিতা। আসরার ই খুদি বা ‘দ্য সিক্রেট্স অব দ্য সেল্ফ',রুমুয ই বি খুদি বা ‘দ্য মিস্টেরিয অব সেল্ফলেস্নেস', পায়ামে মাশরিক বা ‘ম্যাসেইজ ফ্রম দ্য ঈস্ট',যাবুর ই আজাম বা ‘পারসিয়ান সাম্স', পাস চি বয়াদ র্কাদ আয় আকওয়ামে শার্ক বা ‘হোয়াট শুড দেন বি ডানঃও পিপল অব দ্য ঈস্ট' এবং জাভিদ নামা বা ‘টু হিজ সন' ইত্যাদি কবি ইকবালের ফার্সি রচনার অন্তর্ভুক্ত।
উর্দু ভাষাতেও তিনি প্রচুর লিখেছেন। এগুলোর মাঝে কবিতাও আছে , গদ্যও আছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনার নাম করা যাক। কবিতার মধ্যে রয়েছে বাঙ্গে দারা বা ‘কল অব দ্য মার্চিং বেল',বাল-ই-জিব্রিল বা ‘উইংস অব গ্যাব্রিয়েল',যার্ব-ই-কালিম বা ‘দ্য রড অব মোজেজ' ইত্যাদি। এছাড়াও অর্থবিজ্ঞান , ভারতের ইতিহাসসহ আরো বহু প্রবন্ধ তিনি লিখেছেন।
তাঁর বক্তৃতাও রয়েছে প্রচুর। ইংরেজি ভাষায় লেখা তাঁর শ্রেষ্ঠ কিছু লেখা হলো ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পার্সিয়া , দ্য রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম। এটি আসলে আল্লামা ইকবালের ৬টি বক্তৃতার সংকলন। মাদ্রাজ,হায়দ্রাবাদ এবং আলীগড়ে তিনি এই বক্তৃতাগুলো দিয়েছিলেন। সংকলনটি প্রথমে প্রকাশিত হয় লাহোরে,তারপর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে।

বক্তৃতাগুলোর বিষয়বস্তু হলো নলেজ এন্ড রিলিজিয়াস এক্সপেরিয়েন্স, দ্য কনসেপশন অব গড এন্ড দ্য মিনিং অব প্রেয়ার, দ্য হিউম্যান ইগো, প্রিডেস্টিনেশন এন্ড ফ্রি উইল, দ্য স্পিরিট অব মুসলিম কালচার এবং দ্য প্রিন্সিপাল অব মুভমেন্ট ইন ইসলাম।এছাড়া তিনি কয়েকটি গবেষণামূলক প্রবন্ধও লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে ‘ইসলামী খিলাফত' এবং ‘ইসলামী সমাজের প্রতি দৃষ্টি' উল্লেখযোগ্য। ডেভেলপমেন্ট অব মেটাফিজিক্স ইন পার্সিয়া ইকবালের গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলোর একটি। ১৯০৫ সাল থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত সময়কালে ইকবাল লন্ডনে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। সে সময় তিনি তাঁর থিসিস বা গবেষণার মূল উপাত্ত অন্বেষনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর শিক্ষক এবং বন্ধু ডক্টর আর.এ.নিকলসন ইকবালকে তখন পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি যেন আব্দুল করিম জিলির লেখা আল-ইনসানুল কামেল ফি মারেফাতুল আওয়াখের ওয়াল আওয়ায়েল গ্রন্থটি পড়েন। তাঁর পরামর্শে ইকবাল বইটি পড়েন। বইটি পড়ার পর ইকবাল আব্দুল করিম জিলির ওপর পূর্ণাঙ্গ একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাঁর ঐ লেখাটিই থিসিস হিসেবে পরিগণিত হয় এবং এই থিসিসটির ওপর ভিত্তি করেই তাঁকে ডক্টরেট দেওয়া হয়। মূল লেখাটি ১৯০৮ সালে লন্ডনে ছাপা হয়। তারপর উর্দু,ফরাশি এবং ফার্সি ভাষায় অনূদিত হয়।

ইকবালের ভাষ্য অনুযায়ী এই গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য ছিল ইরানী দর্শনের ইতিহাসের মৌলিকত্ব তুলে ধরা। এই গ্রন্থে ইকবাল কেবল প্রাচীন ইতিহাসই বর্ণনা করেন নি,বরং তিনি গবেষকদের চিন্তাজগতে নতুন একটি ধারার প্রবর্তন করতে চেষ্টা করেছেন । ডক্টর ফারিদানীর মতে "ইকবাল তাঁর এই বইতে ইরানী মুসলমান চিন্তাবিদদের চিন্তাজগতে প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছেন এবং সেগুলোকে নতুন দশর্শনের ভাষায় বর্ণনা করতে চেয়েছেন। তিনি সুফিবাদ বা মরমীবাদকে নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই বইতে তিনি মরমীবাদকে একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে উল্লেখ করেছেন এবং জীবনের উন্নত লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্যে ব্যক্তি বা সমাজের জাগৃতির উপায়গুলো প্রদর্শন করেছেন।"
আসরারে খুদি বা দ্য সিক্রেটস অব দ্য সেলফ জলো ফার্সি ভাষায় লেখা ইকবালের প্রথম গ্রন্থ। আল্লাহকে চেনা এবং নিজেকে চেনাই এই গ্রন্থের মূল উপজীব্য। ইকবাল অত্যন্ত সাফল্যের সাথে রাজনৈতিক-সামাজিক এবং দার্শনিক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজেকে এবং আল্লাহকে চেনার উপায়গুলো ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। ইকবাল সাহিত্যের সমালোচকগণ মনে করেন তিনি এই গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিগত আকিদা-বিশ্বাসকেই তুলে ধরেছেন। ইকবালের দৃষ্টিতে সৃষ্টির মূলে আছে খুদি বা আমিত্ববোধ। আর এই বোধ সবার মঝেই রয়েছে।

আমার কবিতা বেপরোয়া আঘাতের সুর
আমি কবিকণ্ঠ এক অনাগত আগামীর
আমার সুরধ্বনি অন্য এক পৃথিবীর
এই ধ্বনি ভিন্ন আরেক কাফেলার

ইকবালের মতে এই আমিত্ব চেতনা যখন প্রেমের সাথে মিশ্রিত হয় তখন বিশাল এক শক্তি অর্জিত হয়। এই আমিত্ব একটা সময় আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে যেতে পারে। এই খুদিই ইসলামের আশ্রয় নিয়ে হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) এর বিধানের অনুসরণ করাতে পারে এবং ইসলাম যা করতে নিষেধ করেছে তা থেকে দূরে রাখতে পারে। ইকবালের মতে এরকম অবস্থাতেই মানুষ আল্লাহর খলিফার মর্যাদায় উন্নীত হতে পারে।

‘আসরারে খুদি'র ভূমিকায় কবি ইকবাল উর্দু ভাষায় লিখেছেন, প্রাচ্যবাসীরা তাদের ব্যক্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে,তারা তাদের আমিত্ব কে ভুলে গেছে,যার পরিণতিতে তারা এখন পাশ্চাত্যের অনুসারী হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইসলামের অনুসারী যারা তাদের উচিত তাদের ভেতরকার আমিত্ব শক্তিকে জাগিয়ে তোলা এবং তকদিরের ওপর সবকিছু ছেড়ে না দিয়ে কর্মতৎপর হওয়া। ইকবালের আসরারে খুদি কাব্য গ্রন্থটি ডক্টর নিকলসন ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর অনূদিত গ্রন্থটি লন্ডনে প্রকাশিত হয়। তারপর আরবি ভাষা, মালয় ভাষা, সিন্ধি ভাষা এবং উর্দু ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়।
আসরারে খুদি প্রকাশিত হবার পর ইকবাল ‘রমুযে বিখুদি' বা ‘দ্য মিস্টেরিয অব সেল্ফলেস্নেস' নামে আরেকটি বই লিখে তাঁর খুদি চিন্তাকে পরিপূর্ণতা দেন। এই গ্রন্থে তিনি ব্যক্তির সাথে সমষ্টির সম্পর্কের ব্যাপারে কথা বলেন এবং সমাজ ও জাতির মাঝে ব্যক্তির বিলীন হওয়া,মুসলিম সম্প্রদায়কে উম্মাতে মুহাম্মাদির সাথে একাত্ম হওয়ার উপায়গুলো বর্ণনা করেন।
‘পায়ামে মাশরেক' বা ম্যাসেইজ ফ্রম দ্য ঈস্ট গ্রন্তটিও ফার্সি ভাষায় লেখা। এই গ্রন্থটি তিনি জার্মানির বিখ্যাত কবি গ্যাটের দিভান অক্সিডেন্টালের জবাবে লিখেছেন।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে উর্দু ভাষায় লেখা ভূমিকাসহ এটি প্রকাশিত হয়। ১৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ ভূমিকায় তিনি গ্যাটের কাব্য সমালোচনা করেন এবং গ্যাটের ওপর ইরানী কবি হাফিজের প্রভাবের কথা বলেন। জার্মান কবিদের ওপর ইরানী কবিদের প্রভাব সম্পর্কে বলেন-‘ফার্সি সাহিত্য থেকে ব্যবহার করা জার্মানীর সাহিত্যিকদের একটা প্রাচীন প্রবণতা। আর জার্মান ভাষায় ইরানী সাহিত্যের অনুবাদ বহু আগে থেকেই শুরু হয়েছে।'
যাই হোক,ম্যাসেইজ ফ্রম দ্য ঈস্ট বা পায়ামে মাশরেক গ্রন্থটি আরবি, তুর্কি এবং উর্দুতেও অনূদিত হয়েছে। এছাড়া প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য ভাষাতেও ইকবালের এই গ্রন্থটির ওপর কমবেশি লেখালেখি হয়েছে এবং অনুবাদও হয়েছে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এ.জে.আরবেরিও এই গ্রন্থের ললে তুর নামক অধ্যায়টি সিনাই অব টিউলিপ নামে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। জার্মানীর প্রাচ্যবিদ হ্যান্সি ম্যাঙ্গিও ইকবালের জীবদ্দশাতেই এই গ্রন্থটির অংশবিশেষ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।

রেনেসাঁর কবি ইকবাল ( ৩)

পাঠক ! গত আসরে আমরা আল্লামা ইকবালের সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেছিলাম। অন্তত তাঁর লেখাগুলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আজকের আসরে তারি ধারাবাহিকতায় কবি ইকবালের কালজয়ী রচনা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। আপনারা যথারীতি আমাদের সাথেই থাকছেন-এ প্রত্যাশা রইলো।
যাবুরই আজাম  (পার্সিয়ান সাম্স) কবি ইকবাল লাহোরির অপর একটি কাব্য গ্রন্থ। যাবুর একটি ঐশী গ্রন্থের নাম। বনী ইসরাইলীদের নবী হযরত দাউদ ( আ ) এর ওপর এই আসমানী কিতাবটি নাযিল হয়েছিল। হযরত দাউদ (আ) খুব সুন্দর কণ্ঠে এই গ্রন্থটি পাঠ করতেন। ইকবাল তাঁর একটি ফার্সি কাব্য গ্রন্থের নাম রেখেছেন যাবুরই আজাম। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে প্রথমবারের মতো বইটি ছাপা হয়। এতে গযল, টুকরো কবিতা এবং দুই পংক্তি বিশিষ্ট কবিতা বা মাসনাবি রয়েছে। একটি হলো গুলশানে রযে জাদিদ বা নতুন রহস্যের পুষ্পোদ্যান এবং বান্দেগি নমেহ বা ইবাদাতনামা। ইকবাল শেখ মাহমুদ শাবেস্তারী এবং তার মূল্যবান সাহিত্যকর্ম গুলশানে রয এর সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। এটিকে তাঁরই নতুন রহস্যের পুষ্পোদ্যান বলে মনে করা যেতে পারে,কেননা ইকবাল শাবেস্তারির গুলশানে রযের স্টাইলেই গুলশানে রযে জাদিদ লিখেছেন। প্রশ্নোত্তরের রীতিতে এটি লেখা হয়েছে।

বান্দেগি নমেহ ইকবালের যাবুরে আজামের দ্বিতীয় অধ্যায়। বান্দেগি নমেহ'তে কবি ইকবাল প্রাঞ্জল ফার্সি ভাষায় লেখা কবিতায় সৃষ্টিশীলতা, শিল্প,মিউজিক,কবিতা,ভাস্কর্য এবং মজলুম জাতিগুলোর সাহিত্যের ব্যাখ্যা এবং সমালোচনা দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন। তবে বান্দেগি নমেহ্'তে ইকবালের সার্থকতা হলো তিনি কেবল দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনা দিয়ে বা চিত্র এঁকেই ক্ষান্ত হন নি,বরং তিনি ঔপনিবেশিকতার জাল ছিন্ন করার উপায় বা পন্থাটাও পাঠক-শ্রোতাদের দেখিয়ে দিয়েছেন।
মাসনাবির পর আসরারে খুদি ওয়া রমুযে বি খুদি এবং জভিদ নমেহ হলো ইকবাল লাহোরির উল্লেখযোগ্য ফার্সি রচনা। ইকবাল তাঁর জভিদনামায় মৌলাভির মাসনাবির প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। এ বইতে তিনি নিজেকে যেন্দে রুদ বা জীবন্ত নদী বলে অভিহিত করেছেন। জভিদ নমে হলো কাল্পনিক এক সফরের ব্যাখ্যা। এ গ্রন্থে তিনি তাঁর পীর-মুর্শিদ মৌলাভির সাথে সকল আসমান,বেহেশত এবং দোযখ সফর করেন এবং কালজয়ী কিছু ব্যক্তিত্বের সাথে কথাবার্তা বলেন। ইরানের বিখ্যাত অভিধান প্রণেতা মরহুম ডক্টর মোহাম্মাদ মঈন ইকবালের জভিদ নমেহ সম্পর্কে বলেছেনঃ ইকবাল এই সফরে সানাঈ গাযনাভি,আবুল আলা মোয়াররী, মহিউদ্দিন ইবনে আরবি এবং ইতালীর দান্তের মতো বিখ্যাত কবি ও দার্শনিকদের মতোই নিজস্ব সৃষ্টিশীল শক্তিমত্তা দিয়ে কাব্যিক মেরাজে গেছেন এবং নিজস্ব মেরাজনামা বা উর্ধ্বারোহনের কাহিনীকে জভিদনমে নাম দিয়েছেন। আধ্যাত্মিক এই সফরে ইকবালের পথপ্রদর্শক এবং মানসিক রাজপথে ছিলেন ইরানের বিখ্যাত মরমী কবি মাওলানা জালালুদ্দিন মোহাম্মাদ বালখিয়ে রুমি।

ইকবাল সমগ্র জীবনব্যাপী যেই লক্ষ্য এবং চিন্তাকে সামনে রেখে কাজ করেছেন তাহলো,জাতির শত্র"র বিরুদ্ধে সংগ্রাম। যেসব শত্র" ভারত ভূখণ্ডকে বিদেশীদের হাতে সোপর্দ করেছে এবং মুসলমানদের ওপর তাদের আনুগত্য চাপিয়ে দিয়েছে,সেইসব শত্র"র বিরুদ্ধেই ছিল ইকবালের সংগ্রাম। ইকবাল ভারতীয় মুসলমানদের মুক্তির জন্যে একজন দূরদর্শী নেতার খোঁজে ছিলেন। এ বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে তাঁর মুসাফির এবং ‘তাহলে কী করা উচিত হে প্রাচ্যবাসী' তে। পশ্চিমা বিশ্বের ধর্মহীন বস্তুতান্ত্রিকতাও তাঁকে ভীষণ কষ্ট দিতো।

ইকবাল লাহোরীর প্রথম উর্দু কবিতার বই হলো বঙ্গ্-ই-দারা। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরে এটি মুদ্রিত হয়। বঙ্গে দারা হলো ঘণ্টাধ্বনি। যেই ঘণ্টাধ্বনি উটের পায়ে বাঁধা হয় যাতে উটের পদক্ষেপ বোঝা যায়। এই শব্দ একদিকে উটের অস্তিত্বের ঘোষণা দেয় অপরদিকে জনগণকে জাগ্রত রাখে। ইকবাল এই গুণগুলোর কথা কবিতায় উল্লেখ করেছেন। বঙ্গে দারা ইকবালের কবিকর্মের প্রাথমিক দিককার রচনা। তরুণ বয়সে তিনি এসব কবিতা লিখেছিলেন এবং আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলামে পড়েছিলেন। এই বইতে জাতীয় চেতনাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

'বলে জিব্রাইল' বা জিব্রাঈলের ডানা গ্রন্থটিও উর্দুতে লেখা। এটি তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। ১৯৩৫ সালে এই গ্রন্থটি ছাপা হয় লাহোরে। এই গ্রন্থটি দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে গযল এবং দু'লাইনের কবিতা। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে,বিচিত্র কাব্যকাহিনী। এইসব কাব্যকাহিনীর বিষয়বস্তুর মধ্যে রয়েছে সাসকিনামা এবং কর্ডোভা মসজিদসহ স্পেনে তিনি যেসব মুসলিম ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখেছেন সেগুলোর বর্ণনা। বলে জিব্রাঈল হলো উর্র্দু ভাষায় ইকবালের কবি মানস বিকাশের মাধ্যম। ইকবাল এই গ্রন্থে চমৎকার সব গযল লিখেছেন। সেইসাথে মুমিনের গুণাবলী এবং ইসলামের সঠিক পরিচিতি,ইনসানে কামেল এবং মুসলমানদেরকে ইসলামী বিধি-বিধান দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকার কথা প্রাঞ্জল ভঙ্গি ও ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

যারবে কালিম ( দ্য রড অব মোজেজ ) উর্দু ভাষায় লেখা তাঁর অপর একটি গ্রন্থ। ১৯৩৬ সালে লাহোরে বইটি প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে তিনি ইসলাম এবং মুসলমান, শিক্ষা-দীক্ষা, নারী, সুকুমার শিল্প ও সাহিত্য, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে। বইটির নামকরণ করেছেন কোরআনের একটি আয়াত অনুসরণে। আয়াতটি হলো ‘অকুল্ নাদরেব্ বি আসাকাল হাজার।' এই নামটি নির্বাচন করার উদ্দেশ্য ছিলো,তিনি মনে করতেন তাঁর বক্তব্য মুসলমানদের অন্তরের পাথরের ওপর মূসার লাঠির মতোই কাজ করবে এবং ঐ পাথর থেকে পানি পানি ফুটবে। আরমুগানে হেজাজ তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ। এটি তাঁর মৃত্যুর পর ছাপা হয়। এখানেও তিনি ঔপনিবেশিকতা এবং মুসলমানদের মুক্তি নিয়েই ভেবেছেন। কবি বাবা তাহের হামেদানির ছন্দশৈলীকে এ গ্রন্থে কাজে লাগিয়েছেন। দুই পংক্তি বিশিষ্ট কবিতায় মক্কা এবং মদীনা যিয়ারতের ইচ্ছে প্রকাশিত হয়েছে। শয়তানের সংসদ নামের ব্যঙ্গ কবিতাংশ বর্তমান বিশ্বের রাজনীতিবিদদের সমালোচনায় মুখর।

রেনেসাঁর কবি ইকবাল ( ৪ )

পাঠক ! গত আসরে আমরা কবি ইকবালের ওপর অপরাপর কবিদের সাহিত্য ও শৈলীগত প্রভাবের কথা বলেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় আজো আমরা ত্রয়োদশ শতাব্দীর ফার্সি ভাষার বিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবাল লাহোরীর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। আপনারা যথারীতি আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না-এই প্রত্যাশা রইলো।

ইকবালের মাতৃভাষা ছিলো পাঞ্জাবী। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ছিল উর্দু। ফলে দুই ভাষাতেই ছিল তাঁর মাতৃভাষা সুলভ দক্ষতা। অথচ তিনি প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় পড়ালেখা করেছেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর চিন্তা-চেতনা,তাঁর বক্তব্য,তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের জন্যে ফার্সি ভাষাকে বেছে নিয়েছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ইকবাল কখনো ইরানে আসেন নি কিংবা কখনো ফার্সি ভাষায় কথা বলেন নি। তবে ফার্সি ভাষার প্রতি তাঁর আগ্রহ বা আকর্ষণ থাকার কারণেই এ ভাষায় তিনি লেখালেখি করেছেন। তাঁর সমকালে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ফার্সি ভাষা ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের কথাবার্তা এবং সাহিত্যের অভিন্ন ভাষা। তিনি তাই এ ভাষাতেই তাঁর দার্শনিক,রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার কারণ উর্দু ভাষা এই চিন্তা প্রকাশের জন্যে উপযুক্ত ছিল না।

প্রথম প্রথম অবশ্য ইকবালের জন্যে ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখাটা একটু কষ্টকরই ছিল। কিন্তু পরে অন্যান্য কবি বন্ধুর উৎসাহে এবং ফার্সি ভাষার প্রতি তাঁর অপরিসীম আগ্রহ ও অনুরক্তির ফলে তিনি সার্থকতা লাভ করেন। তাঁর সমকালে গোলাম কাদের বুলগেরামি জালান্দারীর মতো আরো অনেক পাঞ্জাবী এবং ভারতীয় কবি ফার্সি ভাষায় কবিতা চর্চা করতেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর হয়ে যান এবং সে সময়ের বড়ো একজন কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন।

ইকবাল যদিও ফেরদৌসী, হাফেজ, সাদি, মৌলাভি, ইরাকী প্রমুখের কবিতার সাথে ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন,তারপরও তাঁর কবিতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তাঁর কবিতার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি পুরোণো কাব্যশৈলীর মধ্যেই নতুন নতুন চিন্তাদর্শনের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কিংবা বলা যায় পুনর্গঠন করেছেন। তিনি তাঁর লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে ভারতীয় ফার্সি ভাষীদের এবং ইরানীদের বোধগম্য ও পছন্দের শব্দগুলোই প্রয়োগ করেছেন। ফার্সি কবিতার যেসব ধারা চলমান ছিল যেমন গযল,কাসিদা,রুবাইয়াৎ এবং মাসনাবিÑসকল ধারাতেই তবে কিছুটা স্বতন্ত্র স্টাইলে তিনি কবিতা লিখেছেন। শৈলীগত স্বাতন্ত্র্য যেমন ছিল তেমনি বিষয়বস্তুগত পার্থক্যও ছিল।
ইকবাল তাঁর দার্শনিক চিন্তা,আধ্যাত্মিক চিন্তা,ধর্মীয় চিন্তা ইত্যাদি প্রকাশের ক্ষেত্রে সানাঈ,নিজামী,মৌলাভি,শেখ মাহমুদ শাবেস্তারী প্রমুখের মতো প্রবাদ-প্রবচন এবং কিসসা-কাহিনীর স্টাইলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তিনি ছন্দের কাঠামো ভেঙ্গেছেন। কাব্য রচনার যে আলঙ্কারিক পদ্ধতি রয়েছে,তা অনেক সময় বাঁধা হাত-পায়ের মতো মনে হয়। তিনি মাঝে মাঝে প্রয়োজনবোধে কাব্যরীতির ঐ আলঙ্কারিক বিধি-বিধানের বন্ধ হাত-পা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এমনকি অনেক সময় তিনি কথার মাঝখানে কাব্যশৈলী পরিবর্তনও করেছেন। জাভিদনামাহ এবং মুসাফির নামক দ্বিপদী কাব্যে ইকবাল প্রয়োজনবোধে দ্বিপদীর স্টাইল পরিবর্তন করে গযলের স্টাইলে লিখেছেন।
কবিতার ক্ষেত্রে ইকবাল যে নতুন চিন্তাধারার প্রবর্তন করেন,তারফলে ভারতীয় মুসলমানদের চিন্তারাজ্যে এক ধরনের বিপ্লবের সূচনা হয়। ইকবাল বিশ্বাস করতেন কবিতা বা শিল্পের অপরাপর মাধ্যমগুলো হওয়া উচিত গঠনমূলক,অর্থবহ এবং উচ্চতর লক্ষ্যাভিমুখী। তিনি তাঁর বন্ধু সাইয়্যেদ সোলায়মান নদভীকে উর্র্দুতে লেখা একটি চিঠিতে স্পষ্টভাবেই বলেছেন,তাঁর কবিতা লেখার উদ্দেশ্য পাণ্ডিত্য প্রকাশ করা নয়। চিঠির একাংশে তিনি লিখেছেন,কবিতার ক্ষেত্রে শব্দমালা, সাহিত্যশৈলী আর কোমল আবেগ চর্চার প্রতি আমার আকর্ষণ কম, আমার লক্ষ্য হলো কেবল চিন্তারাজ্যে বিপ্লব ঘটানো।' কবিতাকে তিনি অর্থোপার্জন বা খ্যাতি অর্জনের মাধ্যমে পরিণত করেন নি। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন কবিরা হলেন মানুষ সৃষ্টির কারিগর এবং জাতির অগ্রজ এবং প্রাগ্রসর নাগরিক।
ইকবালের কবিতার বিষয়বস্তু হলো দুঃখ-দুর্দশাগ্রস্ত সমকালীন বিশ্বের চিত্র আঁকা এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। সর্বোপরি কালের সকল অসঙ্গতি থেকে মুক্তির উপায় দেখিয়ে দেওয়া। ইকবাল সবসময়ই প্রাচ্যের স্বাধীনতা এবং মুক্তি,মুসলমানদের স্বাধীনতা এবং মুক্তি এবং তাদের ঐক্য কামনা করেছেন। ইকবাল আত্মসচেতনতা এবং জীবনের মূল্যবোধগুলোর অর্থ উপলব্ধি করাকে মুক্তি লাভের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন,পাশ্চাত্যের অনুসরণই হলো জাগরণের পথের অন্তরায় এবং প্রাচ্য সমাজের পশ্চাৎপদতার মূল কারণ।


রেনেসাঁর কবি ইকবাল (৫)

পাঠক ! কবি ইকবালের জীবন ও কর্ম ভিত্তিক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান রেনেসাঁর কবি ইকবালের আজকের পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। গত আসরে আমরা তাঁর বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের শৈলী ও বিষয়গত পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেছি। আজকের আসরে আমরা ইকবালের কবিচিন্তা ও বিষয়বস্তু চিন্তায় ইরানী সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের প্রভাব সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইকবালের দৃষ্টিতে কবিতা ইসলামী সমাজে চিন্তাগত বিপ্লব প্রতিষ্ঠার জন্যে একটি যথার্থ মাধ্যম। ইকবাল কবিতার মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন মুসলিম জাতিকে একত্রিত করতে,চেষ্টা করেছেন মানবপ্রেম,পবিত্রতা, মুক্তি এবং প্রেমের বাণী সমাজে পৌঁছিয়ে দিতে। তিনি তাঁর এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে উর্দু এবং ফার্সি উভয় ভাষাতেই কবিতা লিখেছেন,তবে ফার্সি কবিতার সংখ্যাই এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে বেশি। মজার ব্যাপারটি হলো ইকবাল নিজে ফার্সি বলতে পারতেন না,অথচ ফার্সি ভাষায় প্রচুর লিখে গেছেন। ফার্সি সাহিত্য অধ্যয়ন এবং ইরানের বড়ো বড়ো কবিদের সাথে পরিচয়ের সুবাদে তিনি এই ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন।

ইকবাল তাঁর একটি কবিতায় ফার্সি ভাষায় কবিতা লেখার কারণ সম্পর্কে বলেছেন, ফার্সি ভাষার ওজস্বিতা এবং সমৃদ্ধি তাঁর উন্নত চিন্তা প্রকাশ করার জন্যে যথার্থ একটি ভাষা। তিনি মনে করতেন এই ভাষার মাধ্যমেই তিনি তাঁর চিন্তা-চেতনাগুলোকে সবচে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারবেন,চিন্তার বিকাশ ঘটাতে পারবেন। কবি ইকবাল লিখেছেনঃ


হিন্দী ভাষার স্বাদ যদি চিনির মতো
প্রকাশভঙ্গিতে দারী আরো মধুরতরো
আমার চিন্তা বিমোহিত দ্যুতিতে তার
তুরের খুরমা শাখা যেন লেখনী আমার
আমার উন্নত চিন্তার জন্যে ফার্সি ভাষা
সৃষ্টিশীল কর্মের যথার্থ বাহন ফার্সি ভাষা

আট শ' বছরেরও বেশি সময় ধরে ফার্সি ভাষা ছিল ভারত উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রিয় ভাষা। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই ভাষা চালু ছিল। এতো দীর্ঘ সময় ধরে ফার্সি ভাষা প্রচলিত ছিল বলে এই ভাষার গুরুত্ব মোটেও হেলাফেলা করার মতো নয়। এই সময়কালে ভারতের প্রত্যেক মুসলিম আরেফ এবং মনীষী ফার্সি ভাষা জানাটাকে অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন। এই ফার্সি ভাষার সৌকর্য ও সমৃদ্ধি ব্রিটিশ উপনিবেশের কাল থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে যেতে একেবারে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। কেবল স্বনামধন্য ও অভিজাত কতিপয় মুসলিম পরিবার ছাড়া আর কোথাও তার অস্তিত্ব রইলো না। এদিক থেকে বিচার করলে অবশ্যই বলা উচিত যে ইকবাল ফার্সি ভাষায় কবিতা লিখে এই ভাষার অসামান্য সেবা করে গেছেন। যেই ভাষাটিকে প্রাচ্যে বা ভারত উপমহাদেশে ভুলতে বসেছিল, সেই ভাষাটি পুনরায় প্রাণ ফিরে পেল।

আগেই বলেছিলাম যে ইকবাল ইরানী ফার্সি মরমী কবি বা বড়ো বড়ো কবিদের কবিতার সাথে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে মৌলাভি এবং হাফেজের কবিতার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল অপিরিসীম। মৌলাভির মাসনাবি এবং হাফেজের গযল তাঁর রক্ত-মাংসের সাথে মিশে ছিলে। তাছাড়া সে সময় পাঞ্জাবে কোরআন এবং নাহজুল বালাগার পরে মৌলাভির মাসনাভি এবং হাফেজের দিওয়ানের কাছে অন্য কোনো গ্রন্থই স্থান পেত না। ইকবাল মৌলাভিকে তাঁর পীর-মুর্শিদ বলে মনে করতেন। এ কারণে ইকবাল বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে ইকবালের যে শিল্প চিন্তা বা তিনি যে চিন্তা-চেতনা পোষণ করতেন, তার ওপর মৌলাভির ব্যাপক প্রভাব ছিল। ইকবালের সমগ্র কবিজীবনে মৌলাভি ছিলেন তাঁর পথপ্রদর্শক এবং প্রেরণার উৎস। ইকবাল নিজেই লিখেছেনঃ

অগ্রজ রুমি প্রিয় মুর্শিদ আমার সুমহান চিন্তার
আমির তিনি নেশাগ্রস্ত আর প্রেমের কাফেলার

মৌলাভির প্রভাব অবশ্য ইকবালের কবিতার মধ্যে সহজেই বোঝা যায়। কারণ ইকবাল তাঁর অনেক কবিতাই মৌলাভির অনুকরণে রচনা করেছেন। তাঁর আসরারে খুদি,রুমুযে বেখুদি, বান্দেগি নমেহ, জভিদ নমেহ, মুসাফির ও বিলআখারে, পাস চে বয়াদ র্কাদ এই আকওয়ামে র্শাক' ইত্যাদি মৌলাভির অনুসরণে রচিত হয়েছে।
ইকবাল ছোটোবেলা থেকেই হাফেজের কবিতার সাথে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাঁর কবিজীবনের শুরুতে হাফেজের বিপরীতে কবিতা লিখেছিলেন। অবশ্য পরে এ জন্যে অনুতপ্তও হয়েছিলেন। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারার পর ঐ কবিতা নষ্ট করে ফেলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি যেসব কবিতা লিখেছিলেন তার সাথে হাফেজের কবিতার সুরের ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। সর্বোপরি ইকবাল যে ইরানী কবিদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

রেনেসাঁর কবি ইকবাল ( ৬ )

পাঠক ! কবি ইকবালের জীবন ও কর্ম ভিত্তিক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান রেনেসাঁর কবি ইকবালের আজকের পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। গত আসরে আমরা ইকবালের কবিতার ওপর ইরানের বিখ্যাত কবিদের প্রভাব এবং তাদের কবিতার সাথে ইকবালের কবিতার মিল সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকের আসরে আমরা ইকবালের কবিতায় ইমাম আলী ( আ ) এর বক্তব্যের প্রতিফলন নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইকবাল সবসময় কবিতা এবং দর্শন নিয়ে বিশেষ করে কোরআনের ওপর ব্যাপক পড়ালেখা করেছেন। তিনি তাঁর জীবীতাবস্থায় কখনোই কোরআন চর্চা থেকে বিরত হন নি। তিনি সমাজ ও মানব উন্নয়নের মহান দায়িত্বভার নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাই তিনি কোরআন নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা প্রদান সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। ইকবাল হযরত মুহাম্মাদ ( সা ) , হযরত ফাতেমাতুয যাহরা ( সা ), ইমাম আলী ( আ ) এবং ইমাম হোসাইন ( আ ) এর অনুসরণে নিজের জীবনকে সাজানোর এবং তাঁদের আদর্শগুলোকে নিজের জীবন ও কবিতায় বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে ইকবালের কবিতা হলো তাঁর আন্তরিক ও অকুণ্ঠ বিশ্বাসেরই প্রতিফলন।
ইকবালের কবিতা প্রমাণ করছে যে, তাঁর অন্তর ছিল সম্পূর্ণ কালিমা মুক্ত। তিনি যেসব বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন সেগুলো একজন খাঁটি ঈমানদার ও মুমিনেরই বক্তব্য। হযরত আলী ( আ ) শাহাদাতকে মর্যাদা ও সততার প্রতীক বলে মনে করতেন। কবি ইকবালও বিখ্যাত বুযুর্গানে দ্বীন হযরত আলী ( আ ) এর মতো মৃত্যু সম্পর্কে অনুরূপ চিন্তাই পোষণ করেন।

তোমাকে বলবো আমি মুমিন ব্যক্তির লক্ষণ
মৃত্যু আসে যখন হাসিমুখে করে সে বরণ

কবি ইকবালও মৃত্যুকে তাঁর প্রশান্তির কারণ বলে মনে করতেন। কেননা তিনি শিখেছেন যে রুহ হলো অবিনশ্বর,অমর। মৃত্যু হলো কেবল মাটির দেহ থেকে তার বিচ্ছিন্ন হওয়া। এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কবি ইকবাল তাঁর মৃত্যুর কদিন আগে তাঁর ভাইকে বলেছিলেন "আমি মুসলমান,তাই আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না।"
ইসলামের প্রতি ইকবালের ব্যাপক জ্ঞান থাকার কারণে এবং কোরআন হাদীসের সাথে তাঁর ব্যাপক পরিচিতির কারণে তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল ব্যাপক বি¯তৃত। যার ফলে ইসলামী চিন্তা-চেতনাসমৃদ্ধ তাঁর বক্তৃতাগুলো শ্রোতাদের প্রশংসা কুড়াতে পেরেছিল সহজেই। কবিত্ব এবং শিল্পের ব্যাপারে যখন যথাযথ ইকবালের বোধ ও উপলব্ধি হলো, তখন তিনি ধর্মীয় বাস্তবতা এবং নবী-রাসূলগণের রেসালাতের তাৎপর্যও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর এসব কিছুকেই তিনি মনে করতেন বিশ্বমানবতার কল্যাণের আধার। তাঁর মতে শিল্পকলার লক্ষ্যই হলো মানবজীবনের সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্য বিধান করা। " জীবনসত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে মানুষের যেসব চেষ্টা-প্রচেষ্টা রয়েছে,সেগুলোরই প্রতিনিধিত্ব করে শিল্প।"
ইসলাম এবং ইসলামের নবীকে ভালোবাসা ইকবালের মন ও মননে ইংরেজি ভাষায় রাসূল সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনার আগ্রহ জন্মিয়েছে। কিন্তু তাঁর এই চিন্তা বাস্তবায়িত হয় নি। কেননা ইকবাল কবিতার ভূবনে এতো বেশি বুঁদ হয়ে গিয়েছিলেন যে গবেষণাকর্ম বা গদ্য রচনায় তিনি তেমন একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন না। ইকবাল মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্তও কবিতা রচনা থেকে বিরত ছিলেন না। মৃত্যুর আধা ঘণ্টা আগেও তিনি ধর্মানুরাগ এবং রাসূলপ্রীতি সম্পর্কে কবিতা লিখে গেছেন।


হারানো সঙ্গীত ফিরে আসবে আবার
আসে নি যা কখনো আর
হেজাজের মৃদুমন্দ আসবে আবার
আসে নি যা কখনো আর
জ্ঞানের দারিদ্র্যপূর্ণ এই পৃথিবীতে
রহস্যের সেই পূণ্য জ্ঞান
ফিরে আসবে আবার
আসে নি যা কখনো আর

ইসলামী জ্ঞানের সমৃদ্ধির কারণে ইকবাল তাঁর আদর্শ সমাজকে তৌহিদ, কোরআন, নবুয়্যত, কাবার মানদণ্ড এবং সামাজিক খুদির উন্নয়ন ও অন্যান্য ধর্মীয় কার্যক্রমের ভিত্তির ওপর কল্পনা করতে পেরেছিলেন।

স্রষ্টা বানালেন এই দেহকাঠামো সুন্দর করে
রেসালাত তাতে ফুঁকিয়েছে বায়ু প্রাণের তরে
বিশ্বব্যাপী আমাদের অস্তিত্ব রেসালাতের পথ ধরে
ধর্ম আমাদের জীবন বিধান রেসালাতের পথ ধরে
................ ............... .............
লক্ষ মানুষ একমনা এই রেসালাতের পথ ধরেই
দেহের প্রতি অঙ্গ যেমন অবিচ্ছেদ্য এক দেহেরই

ইকবাল কোরআন , ইসলামী জ্ঞান এবং বুযুর্গানে দ্বীনের জীবনাভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের প্রয়োজনে কবিতা লিখেছেন। ইসলামের সহমর্মিতা,বিশ্বাস ও ঐক্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্যে তিনি কবিতাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেজন্যেই তিনি মুসলিম ঐক্যের আহ্বায়কের শিরোপা লাভ করেছেন। হযরত আলী (আ) এর ওপরও ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। তবে তিনি এও মনে করতেন যে শক্তিবলে ইমাম আলী ( আ ) খায়বার বিজয় করেছিলেন,সেই শক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া এক বিশেষ অনুগ্রহমাত্র।

রেনেসাঁর কবি ইকবাল (৭ )

পাঠক ! আল্লামা ইকবালের জীবন ও কর্ম ভিত্তিক ধারাবাহিক আলোচনার আজকের পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আশা করি আপনারা যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। গত আসরে আমরা বলেছিলাম ইকবাল তাঁর ইসলামী জ্ঞানের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে তাঁর কাক্সিক্ষত আদর্শ সমাজ গঠনের চেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁর এই আদর্শ সমাজ চিন্তার মূলে ইসলামের যেসব মৌলিক উপাদান কাজ করেছিল তা হলো তৌহিদ,নবুয়্যত,কোরআনের শিক্ষাসমূহ, মক্কা কেন্দ্রিকতা,খুদির উন্নয়ন এবং অন্যান্য ধর্মীয় বিষয়-আশয়। আরো বলেছিলাম যে ইকবালের কবিমনে বিখ্যাত অনেক কবির মাননিক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে ইমাম আলী ( আ ) এর বাণী। এর প্রভাব এতো গভীরে যে সহজে তা অনুমেয় নয়। যাই হোক,এরি ধারাবাহিকতায় আজ আমরা কথা বলবো।
ইকবাল তাঁর কবিতায়,তাঁর প্রবন্ধে এবং তাঁর বক্তৃতায় সবসময় ইতিহাসের পাতার ভাঁজে ভাঁজে পড়ে থাকা ইসলামের মহান ব্যক্তিত্ব এবং মুসলিম বীরদেরকে মুসলমানদের চোখের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ইকবালের কলমে মহান এইসব মনীষীর মধ্যে সর্বপ্রথম যাঁর নামটি উঠে এসেছে তিনি হলেন হযরত মুহাম্মাদ ( সা )। এরপরের সারিতে রয়েছে রাসূলে খোদার আহলে বাইতের সদস্যদের স্বর্ণোজ্জ্বল নামগুলো,যার শীর্ষে রয়েছেন হযরত আলী ( আ )। ইকবাল তাঁদের স্মরণে অত্যন্ত আন্তরিকতা এবং পরিপূর্ণ সততার সাথে কবিতা লিখে তাঁর কবিতাকে সুগন্ধিপূর্ণ করেছেন।ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের প্রফেসর ডক্টর রদফার বলেছেনঃ ‘আমরা যখন আলী ( আ ) কে নিয়ে লেখা ইকবালের কবিতা পড়বো, তখন আমাদের মনে হবে যে ইকবাল হলেন সত্যিকারের একজন আলী বিশেষজ্ঞ।'

ইকবাল আলী ( আ ) কে অনেক বড়ো মাপের একজন মানুষ বলে মনে করেন। ইকবালের দৃষ্টিতে মুমিন ব্যক্তি হলেন তিনি, যিনি কথা ও কাজে ভারসাম্যপূর্ণ এবং মিতাচারী। ইকবাল তাঁর ‘যারবে কালিম' নামক গ্রন্থে মুসলমান এবং মুমিন ব্যক্তির পরিচয় প্রদান করতে গিয়ে লিখেছেনঃ যদি কারো মধ্যে শক্তিমত্তা, পবিত্রতা, মহানুভবতা এবং উদারতা-এই গুণগুলো একত্রে থাকে তাহলে সে স্পষ্টতই মুসলমান......মুমিন ব্যক্তি হলো সেইসব কুয়াশাবিন্দুর মতো যে টিউলিপের বেদনাহত অন্তরকে শীতল করে দেয়। আবার সেই তুফানের মতো যেই তুফান সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলে। তার দিন এবং রাত্রি হলো চিরন্তন আধ্যাত্মি সংগীতের মতো,যেই সংগীত কেবল স্রষ্টারই গুণ গায় এবং যেই সুরেলা সংগীতের মাধুর্য সূরা আর-রাহমানের মতো।'
ইকবাল এই যে মুসলমান এবং মুমিনের গুণাবলীগুলো উল্লেখ করলেন, এই বর্ণনা ইসলামের বিখ্যাত মনীষীদের বর্ণনার সাথে বিশেষ করে হযরত আলী ( আ ) এর বর্ণনার সাথে মিলে যায়। ইকবাল যারবে কালীমের অন্যত্র লিখেছেন,"মুমিন ব্যক্তি বন্ধুদের মাঝে সিল্কের মতো নরম ও ভদ্র স্বভাবের আর শত্র"দের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন।" ইকবালের দৃষ্টিতে পূর্ণ মুমিন ব্যক্তির মানদণ্ড হলেন হযরত আলী (আ)। তিনি একদিকে ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের প্রতীক,যাঁকে মোকাবেলা করার মতো সাহস কারো ছিল না। অপরদিকে অসহায় এতিমদের ব্যাপারে তিনি এতো বেশী কোমল প্রকৃতির ছিলেন যে তাঁর মতো সহায়তা দানকারী ইতিহাসে বিরল। এইসব গুণ লক্ষ্য করেই ইকবাল লিখেছিলেন :

দার বারোবারে সাখ্তি সাখ্ত আস্ত্
ভা দার বারোবারে র্নামি মোলায়েম.....
আব্রিশাম দার বায্মে ওন্স
ভা ফুলদ দার রায্ম্গহে হাক্ক্ ও বতেল......

অর্থাৎ হযরত আলী ( আ ) কঠোরতার বিরুদ্ধে কঠোর এবং নরমের বিপরীতে নরম কোমল। বন্ধুত্বের আতিথেয়তায় তিনি সিল্কের মতো কোমল,আবার সত্য মিথ্যার যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ইস্পাতের মতো কঠিন। হযরত আলী ( আ ) এর জ্ঞান সম্পর্কে নবী করীম ( সা ) একবার বলেছিলেন,আনা মাদিনাতুল এলম,ওয়া আলীয়্যূন বা..বুহা অর্থাৎ আমি হলাম জ্ঞানের নগরী আর আলী হলো সেই নগরীর দ্বার। এই হাদীসটির ভিত্তিতে ইকবাল একটি কবিতা লিখেছিলেন। তার দুটি পংক্তি এরকমঃ

জা'তে উ দারভযেয়্যে শাহরে উলুম
যীরে ফারমনাশ হেজাজ ও চীন ও রোম

আল্লামা ইকবাল ভালো করেই জানতেন যে ইমাম আলী ( আ ) সামাজিক, অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক এবং বিশ্বাসগত সকল ক্ষেত্র থেকেই জাহেলি যুগের কালিমাগুলো অপসারণ করতে চাইতেন এবং যার যার উপযুক্ত মর্যাদা দিতে চাইতেন। ইকবাল হযরত আলী ( আ ) এর মাঝে তিনি উচ্চতরো রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নিদর্শন দেখতে পেয়েছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা, সামাজিক সচেতনতা, ইবাদাত বন্দেগী, সাংসারিক বিষয়-আশয়, সন্তান প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণ, বীরত্ব , তাকওয়া, ন্যায়নিষ্ঠা ইত্যাদি গুণাবলী। এইসব গুণাবলীর কথা উল্লেখ করে ইকবাল সমকালীন মুসলিম জনগোষ্ঠীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন-তোমরা এরকম মহান ব্যক্তিত্ববর্গের গুণগুলোর মধ্য থেকে কতোটা অর্জন করেছো ?
কবি ইকবাল তাঁর ‘বঙ্গে দারা' গ্রন্থে বলেছেন,তোমার অস্তিত্বের ঐ মৃত্তিকায় যদি স্ফুলিঙ্গ থাকে তাহলে ধনী-গরীবের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিও না। কেননা যবের রুটি খেয়ে সাদাসিধে জীবনযাপন করেই হযরত আলী ( আ ) হায়দারী শক্তিমত্তা অর্জন করেছিলেন। ইকবাল আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এবং রাসূলে খোদার দরবারে মোনাজাত করেছেন মুসলমানদেরা যেন হযরত আলী ( আ ) এর চরিত্রের রঙ্গে রঙ্গীন হতে পারেন।


রেনেসাঁর কবি ইকবাল (৮)

পাঠক ! কবি ইকবালের জীবন ও কর্ম ভিত্তিক সাপ্তাহিক আয়োজন রেনেসাঁর কবি ইকবালে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আশা করি আপনারা যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। গত আসরে আমরা ইকবালের জীবনী এবং তাঁর কবিতার ওপর ইরানের বিখ্যাত কবিদের ও দ্বীনী ব্যক্তিত্বদের প্রভাব নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজকের আসরে আমরা ইকবালের কবিতায় মানুষ,প্রেম এবং বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।

মানুষ,জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এমন এক বস্তু যা বিশ্বের বড়ো বড়ো কবি সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। বড়ো লেখকদের মাঝে এমন খুব কমই পাওয়া যাবে যাঁরা এই তিনটি বিষয় নিয়ে ভাবেন নি,কিংবা কথা বলেন নি। ইকবাল মানুষের পূর্ণতার জন্যে এবং আল্লাহকে চেনার জন্যে প্রেম ও প্রজ্ঞাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। প্রেম হলো সৃশনশীলতা,সৃষ্টির প্রেরণা। প্রজ্ঞার বিপরীতে তার অবস্থান। প্রেমের রয়েছে পরিবর্তনের শক্তি এবং প্রেম মানুষের ভেতর বিচিত্র গুণাবলীর সৃষ্টি করতে পারে। প্রেম আরো পারে মানুষের বস্তুবাদী গুণগুলোকে পরিহার করে মানুষকে আধ্যাত্মিকতার পথে ধাবিত করতে।
ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মাদ মাহদি রুকনি বলেছেন,ইকবাল কাব্যে প্রেম হলো তাঁর দর্শনের স্থিতিশীলতার মূল উৎস। ইকবাল তাঁর কাব্যে পাঠককে বারবার প্রেমের রাজ্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কেননা প্রেম আভ্যন্তরীণ সৃষ্টিশীলতা বৃদ্ধি করে যার ফলে বড়ো ধরনের কাজ করা সম্ভব হয়। ইকবাল মনে করতেন প্রেম হলো বিপর্যস্ত জীবনে মানব মুক্তির সোপান। তিনি স্মরণ করে দিয়েছেন যে, প্রেম আর মানুষ আদিকাল থেকেই ছিল নিত্যসঙ্গী ও সদাসহচর। প্রেমকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন মানুষকে যেন বোঝা থেকে নিষ্কৃতি দেয় এবং এই পৃথিবীর তাবৎ আবর্জনা থেকে যেন মানুষকে মুক্তি দেয়। তিনি লিখেছেন-

بيا اين خاكدان را گلستان ساز
جهان پير را ديگر جوان ساز
بيا يك ذره از درد دلم گير
ته گردون بهشت جاودان ساز
ز روز آفرينش همدم استيم
همان يك نغمه را زير و بم استيم

এসো এই আবর্জনার স্তুপকে ফুল বাগান বানিয়ে দাও
বৃদ্ধ এই পৃথিবীকে আবার যৌবনদীপ্ত যুবক বানিয়ে দাও
এসো আমার হৃদয়ের ব্যথাগুলোর খানিকটা নিয়ে যাও
এ অন্তরে বেহেশ্তের চিরন্তন প্রশান্তির ধারা বইয়ে দাও
সৃষ্টির শুরু থেকেই তোমার সাথে আছি নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে
আছি সুরের উদারা থেকে তারায় একাকার মিলেমিশে।

ইকবালের কবিতায় প্রেম আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ হিসেবে এবং ইতিবাচক ও গঠনমূলক একটি উপাদান হিসেবে এসেছে। প্রেমকে ইকবাল এমন এক শক্তি বলে মনে করেন, যেই শক্তির বলে মানুষের ভেতরকার সৃজনী শক্তি ও মেধার শক্তি জেগে ওঠে। আর শক্তির প্রেরণায় মানুষ তার মাশুকের কাছে বা প্রেমাস্পদের দিকে ছুটতে থাকে। কবি ইকবালের ভাষায়-

هست معشوقي نهان اندر دلت
چشم اگر داري بيا بنمايمت
عاشقان او ز خوبان خوبتر
خوشتر و زيباتر و محبوبتر
دل از عشق او توانا مي شود
خاك همدوش ثريا مي شود

তোমার অন্তরে লুকিয়ে আছে এক প্রেমাস্পদ
যদি চোখ থেকে থাকে আসো তোমাকে দেখাই
তার প্রেমিক ভালোর চেয়েও ভালো
প্রফুল্লময়,চমৎকার এবং প্রিয়তরো
তার প্রেমে এই অন্তর হয়ে ওঠে সামর্থবান
মাটিও হয়ে ওঠে সপ্তর্ষিমণ্ডলের মতো উজ্জ্বল

ইকবালের মতে মানুষের উচিত তার ভেতরের কল্পিত মূর্তিকে ভেঙ্গে ফেলা এবং প্রেমের অনস্বীকার্য শক্তিমত্তা দিয়ে নিজেকে মূল লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ইকবালের মতে তা করা হলে আল্লাহর অনুগ্রহ তার ওপর এমনভাবে বর্ষিত হবে যে মানুষ যমিনের পর আল্লাহর খলিফা হবার যোগ্য হয়ে উঠবে।

সর্বোপরি বলা যায় যে কবি ইকবালের কবিতায় সবসময়ই প্রেম একটি প্রশংসনীয় বিষয়।বস্তুবাদী চিন্তার বেড়াজালে যারা আটকে পড়ে গেছে,তাদের জন্যে প্রেমই হচ্ছে যথার্থ আশ্রয়স্থল। তিনি মনে করেন, প্রেমের পথেই একটি মানুষ দায়িত্ববান ও ব্যক্তিত্ববান হয়ে উঠতে পারে। কেননা প্রেম হচ্ছে বস্তুতান্ত্রিক উপাদান থেকে ভিন্ন এমন এক রত্ন যার তীক্ষ্ণধার তরবারীর সাহায্যে কঠিন পাথরকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলা যায়।
ইকবালের প্রেম ভাবনা কেবল প্লেটোনিক নয়। তাঁর দৃষ্টিতে প্রেম হচ্ছে মানুষের স্বাধীনতা এবং মানবমুক্তি। তিনি যেখানেই প্রেম নিয়ে কথা বলেছেন সেখানেই তাঁর লক্ষ্য ছিল উন্নতি ও অগ্রগতি। ইকবালের কাব্যভূবনের সর্বত্রই প্রেম স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর।

عشق به دشوار ورزيدن خوش است
چون خليل از شعله گل چيدن خوش است

কঠোরতায় প্রেম এনে দেয় নির্জলা প্রশান্তি
যেমন খলিল অগ্নিকুণ্ডে বসে ফুল তুলে খুশি

রেনেসাঁর কবি ইকবাল (৯)

পাঠক ! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। কবি ইকবালের জীবন ও কর্মভিত্তিক ধারাবাহিক আলোচনার আজকের আসরে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আশা করি আপনারা যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। গত কয়েকটি আসরে আমরা ইকবালের জীবন ও কর্ম থেকে কিছু কিছু বিষয়ে আলাপ করার চেষ্টা করেছি। আজো আমরা তাঁর সামগ্রিক জীবনের কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।

আমাদের আপনারা জানেন যে ইকবাল পড়ালেখা করেছেন স্বদেশ এবং স্বাদেশের বাইরে বৃটেনে,জার্মানীতে। বাইরে পড়ালেখা করার সুবাদে তিনি তাঁর সমকালীন শ্রেষ্ঠ কবি সাহিত্যিক দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদদের সাহচর্য লাভ করার সুযোগ পেয়েছেন। টমাস আর্নল্ড, প্রফেসর ম্যাক টিগার্ড,প্রফেসর এডওয়ার্ড ব্রাউন,প্রফেসর রেনল্ড নিকলসন প্রমুখ ব্যক্তিত্ববর্গের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে জার্মানীর মিউনিখ ইউনিভার্সিটিতে যান এবং দর্শন শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর আর্নল্ডের পরিবর্তে কিছুছিন শিক্ষকতাও করেন। পশ্চিমা চিন্তাবিদ বা দার্শনিকদের মধ্যে কবি ইকবাল যে কজনকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন এবং যাদের লেখা বা দর্শন পছন্দ করতেন তাদের মধ্যে কজন হলেন জন লক,কান্ট, হেগেল,গ্যাটে,টলস্টয়। আর প্রাচ্যের কবিদের মধ্যে মাওলানা জালালুদ্দিন বালখির কবিতার ভক্ত ছিলেন তিনি।

ইতোপূর্বে আমরা বলেছিলাম যে ইকবাল তাঁর লেখালেখি শুরু করেছিলেন ফার্সি ভাষায়। প্রথমে তিনি থিসিস লিখেছিলেন ফার্সিতে। এরপর কবিতাও লেখেন ফার্সিতে। ফার্সি ভাষায় কাব্যচর্চা করার কারণে ইকবাল খুব সহজেই মুসলিম দেশগুলোতে তো বটেই সমগ্র বিশ্বেই কবি খ্যাতি পেয়ে যান। বহু গবেষক বা চিন্তাবিদের মতে ইকবাল ছিলেন মুসলিম দেশগুলোর মাঝে পারস্পরিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বানকারী প্রাথমিক কবিদের অন্যতম। মুসলমানদের চিন্তা চেতনায় তিনি যে জাগরণ নিয়ে এসেছেন,তাঁর বাঙ্গে দারা নামক গ্রন্থে তার স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যাবে। ১৯০৮ সালের আগস্ট মাসে তিনি তাঁর স্বদেশে ফিরে আসেন বাইরে থেকে। ফিরে এসেই লাহোর সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

ইকবাল যেহেতু পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে পরিচিত ছিলেন সেহেতু প্রাচ্যের দার্শনিক বা চিন্তাবিদদের সমালোচনা করতেন। কারণ পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির অগ্রহণযোগ্য দিকগুলোর কথা জেনেও তাঁরা কেন পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করছেন এই প্রশ্নটি ইকবালকে তাদের ব্যাপারে সমালোচক করে তোলে। ইকবালের বক্তব্য হচ্ছে প্রাচ্যের দার্শনিকরা বা চিন্তাবিদরা পাশ্চাত্যের কাছে নিজেকে সমর্পন করে পরাধীন হয়ে গেছেন,এবং নিজস্ব সত্ত্বার কথা ভুলে গেছেন। পাশ্চাত্যের বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে তাঁরা আত্মহারা হয়ে যান। ইকবাল ভারতে ফিরে আসার প্রাথমিক ক'বছরে আসরারে খুদি এবং রুমুযে বিখুদি গ্রন্থ দুটি লেখেন।

তাঁর এই লেখাগুলো তাঁর শিক্ষক রিনল্ড নিকলসনের হাতে গিয়ে পৌঁছায়। নিকলসন আগে থেকেই ইকবালের মেধার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তাই ইকবালের বইগুলো হাতে পেয়ে তিনি গভীর মনোযোগের সাথে পড়েন। পড়ার পর তিনি ইকবালের কবিতাগুলোকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। এ কারণে ইকবাল ভারতে পরিচিত হবার আগে বৃটেনে অনেক বেশী পরিচিতি পান।

১৯২৬ সালে ইকবাল পাঞ্জাবের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার নানা জটিলতা এবং স্বাধীনতাপ্রিয় মনোভাবের কারণে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে আগ্রহী হন। ১৯৩০ সালে আহমাদাবাদে মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি পাকিস্তান সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। তাঁর পায়ামে মাশরেক নামক কাব্য গ্রন্থে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার কথা বলা হয়েছে। তিনি বর্ণবৈষম্যের বিরোধী ছিলেন,ঔপনিবেশিকতার বিরোধী ছিলেন,গোত্রপ্রীতির বিরোধী ছিলেন। ইকবাল লিখেছেনঃ


نه افغاني و نه ترك و تتاريم
چمن زاديم و از يك شاخساريم
تميز رنگ و بو بر ما حرام است
كه ما پروردة يك نو بهاريم

আমরা নই আফগানী,তুর্কি কিংবা তাতারী
ঘাসের মতো কিংবা বিভিন্ন শাখা যেন একই বৃক্ষের
বর্ণ-বৈষম্য আমাদের প্রতি হারাম
কেননা আমরা সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি

রেনেসাঁর কবি ইকবাল (১০)

পাঠক ! ইকবালের জীবনেতিহাসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভিন্ন দিক নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে খানিকটা আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনাদের ভালো লেগে থাকবে। তাঁর শিক্ষা জীবন,ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের সাথে তাঁর যোগাযোগ এবং এ ভাষায় তাঁর লেখালেখি চর্চার ইতিবৃত্ত নিয়েও কথা বলেছি আমরা। বিশেষ করে ইরানী বিখ্যাত কবিদের প্রভাব তাঁর ওপর কীভাবে পড়েছে তা নিয়েও খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইকবালের কবি হয়ে ওঠার বিষয়টি নিয়ে খানিকটা কথা বলা দরকার বলে মনে করি। আজকের আসরে আমরা তাই এ বিষয়টি নিয়ে খানিকটা কথা বলার পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলবো।

কবি ইকবাল লাহোরী ছোটো বেলাতেই তাঁর জন্মস্থান শিয়ালকোটের পুরোণো মাদ্রাসায় নিয়ম অনুযায়ী ইসলামী জ্ঞান এবং ঐশীগ্রন্থ আল-কোরআনের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পান। তারপর তিনি স্কটল্যান্ডের খ্রিষ্টান মিশনারীদের প্রতিষ্ঠিত ‘স্কচ মিশন' নামক স্কুলে যান। স্কুলটি শিয়ালকোটেই অবস্থিত ছিল। সেখানে যাবার পর নতুন নতুন জ্ঞানের সাথে পরিচিত হন। কবি ইকবালের পিতা ছিলেন শেখ নূর মোহাম্মাদ। তিনি ছিলেন সেলাই কাজের পেশায় নিযুক্ত। তিনি সাহিত্য ভালোবাসতেন। আধাত্মিক সাহিত্য ও কবিতার সাথে তাঁর ভালো পরিচয় ছিল। বিশেষ করে শেখ আকবর,মহিউদ্দিন ইবনে আরবীর ওপর তাঁর ভীষণ অনুরাগ ছিল। তিনি তাঁর বাসাতেই ফুসুসুল হুক্ম এবং ফাতুহাতে মাক্কিয়ে নামক বিখ্যাত গ্রন্থগুলো পড়েছেন।

পিতার এই অনুরাগের সুবাদে পুত্র ইকবালও সেই ছোটবেলাতেই আধ্যাত্মিকতা নামক শব্দ বা এই পরিভাষাটির সাথে পরিচিত হন। শেখ নূর মোহাম্মাদ ছিলেন কাদেরিয়া সিলসিলার অনুসারী। সেজন্যে কবি ইকবালও কৈশোরে এই তরিকার অনুসারী হয়ে পড়েছিলেন। কবি হবার কারণে ইকবাল সেই কৈশোরেই বিভিন্ন আসরে কবিতা পড়তেন,সাহিত্য সভায় যেতেন। সেই কৈশোরেই স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। লেখালেখিতে তাঁর শিক্ষক সাইয়্যেদ মীর হাসান ইকবালকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরণা দিতেন। উর্দু কবিতা ও সাহিত্যের শিক্ষক দাগ দেহলভিও এব্যাপারে ইকবালকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করতেন।

ইকবাল মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন শেষ করার পর ১৮৯৫ সালে লাহোরে যান এবং সরকারী কলেজে পড়ালেখা শুরু করেন। এ সময় তিনি ফার্সি ভাষা,আরবি ভাষা,ইংরেজি সাহিত্য ও ইউরোপীয় নতুন সাহিত্য ধারার সাথে ভালোভাবে পরিচিত হন। সেইসাথে পাশ্চাত্য দর্শনের সাথে তাঁর প্রাথমিক পরিচয় ঘটে এখানেই। দর্শন ছাড়াও তিনি ইতিহাস, অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিষয়েও পড়েন। এ সময় তিনি আব্দুল কারিম জিলীর দৃষ্টিতে ‘ইনসানে কামেল' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁর শিক্ষক প্রফেসর আর্নল্ডের অনুপ্রেরণায় ইকবাল অর্থনীতি বিষয়ক একটি ইংরেজি বই উর্দু ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি নিজেও অর্থনীতি বিষয়ে একটি বই লেখেন।
বিশ শতকের শুরুর দিকে ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতা চিন্তা, মুক্তিকামিতাসহ চিন্তাজগতে ব্যাপক তোলপাড় ছিল। তাই তরুণ বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক কদর ছিল তখন। ইকবাল এ সময় লেখাপড়ার পাশাপাশি সাহিত্য ও কবিতার আসর বা এ বিষয়ক সংস্থাগুলোতে কাটাতেন। তাঁর বয়স কিন্তু খুব বেশি ছিল না,তিরিশ ছুঁই ছুই। অথচ তখনি তাঁর কবিতা সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতে শুরু করে। তাঁর কবিতা এক হাত থেকে অপর হাতে ঘুরতে ঘুরতে তিনি ভারতের লখনৌ,দিল্লীসহ বিভিন্ন এলাকায় শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। এই সময়ে তাঁর লেখায় আধ্যাত্মিকতার প্রাথমিক রং লেগেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক-ধর্মীয় ও সামাজিক পরিস্থিতির কারণে সমাজ সচেতন কবি ইকবালের কবিতা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ও সামজিক রূপ পরিগ্রহ করে।
কবি ইকবালের ব্যক্তিত্বে এ সময় যিনি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর নাম হলো মৌলভি নজির আহমদ দেহলভি। লাহোরে ইকবাল ১০ বছর কাটিয়েছেন। এই ১০ বছরে তিনি মৌলভি নজির আহমদের কাছে নিয়মিত যাওয়া আসা করতেন। আঞ্জুমানে হেমায়েতে ইসলাম আয়োজিত বৈঠকে ইকবাল বক্তৃতা দিতেন। এই আঞ্জুমানের কাজের ব্যাপারে ইকবাল যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং সকল আসরেই কবিতা পাঠ করতেন। নজির আহমদ তখন থেকেই ইকবালের কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করতেন এবং ইকবালের কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত থাকতেন। খুদিচিন্তা,পাশ্চাত্য দর্শন কিংবা তাসাওউফের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ইকবাল যেসব সমালোচনা করতেন সেগুলো মূলত মৌলভি নজির আহমদের প্রভাবেই।

ইকবাল যখন মাওলানা জালালুদ্দিন বালখিয়ে রুমির কবিতার সাথে পরিচিত হন তখন থেকে আধ্যাত্মিকতার সাথে পুনরায় তাঁর নিবীড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইকবালের বাকি জীবনে এই সম্পর্কচ্ছেদ আর ঘটে নি। আরমুগানে হেজায, আসরারে খুদি,জাভিদনামা,বালে জিব্রাঈল প্রভৃতি গ্রন্থে রুমি যেন ইকবালের আধ্যাত্মিক মুরব্বি হিসেবে সবসময় তাঁর মন এবং মননে আসীন ছিলেন। ইউরোপ যাবার পর নীৎসে, শোপেনহাওয়ার,বার্গসঁ প্রমুখ দার্শনিকের সাথে পরিচিত হবার পর ইকবালের দর্শন চিন্তা বিশেষ করে তাসাওউফ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে খানিকটা পরিবর্তন আসে। প্লেটোর মতো দার্শনিকদের চিন্তারও সমালোচক হয়ে ওঠেন তিনি। গাযযালিকে তিনি তখন কান্ট থেকে আলাদা ভাবতেন না। চিন্তাজগতে এই পরিবর্তন সত্ত্বেও মাওলানা রুমির ব্যাপারে কিন্তু ইকবালের দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনোরকম পরিবর্তন আসে নি।

রেনেসাঁর কবি ইকবাল-(১১)

পাঠক! আগেও বলেছি যে মানুষ,বুদ্ধি-বিবেক এবং প্রেম-এগুলো বিশ্বের বিখ্যাত কবি এবং লেখকদের অনিবার্য বিষয়। প্রত্যেক চিন্তাশীল মানুষই মানুষের পরিচয়,মানুষের মন-মানসিকতা,তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং প্রজ্ঞা ও প্রেম সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। খুব কম কবি বা লেখককেই পাওয়া যাবে যিনি এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবেন নি বা কথা বলেন নি। মুসলমানদের কাছে মানুষের মর্যাদা অনেক উন্নত পর্যায়ের। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং মানুষকে তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব বলে উল্লেখ করেছেন। কেবল সৃষ্টির সেরাই নয় বরং পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে মর্যাদার শীর্ষে আসীন করেছেন। তাই বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক বা দার্শনিকমাত্রই মানুষ সম্পর্কে বিশেষ করে পরিপূর্ণ মানুষ অর্থাৎ ইনসানে কামেল সম্পর্কে কথা বলেছেন।

ইকবালের কবিতায় বিষয়গত বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তবে সেসব বিষয় মানব জীবনকেই সার্থকতা দিয়েছে। পূর্ববর্তী সকল বিখ্যাত কবিই মানব জীবনকে নশ্বর বলে মেনে নিয়েছেন এবং দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়া স্বল্পায়ু জীবনের কথা বলেছেন। সেইসাথে জীবন বা আয়ুষ্কালের ক্ষেত্রে মানুষের করণীয় কিছু নেই বলে নিজস্ব অসহায়তার কথা প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে সবাই নিঃসন্দেহ যে মানুষ মরণশীল এবং সবাইকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই বলে মৃত্যুর কথা ভেবে ভেবে নিজের সকল কাজকর্ম বা চেষ্টা-প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়ে দুশ্চিন্তার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে পড়াটা কি ঠিক? ইকবালের কবিতার সমালোচকগণ বা বিশ্লেষকগণ মনে করেন যে মানুষ এবং সমাজ হলো কবি ইকবালের কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়।

ইকবাল হলো মানুষের কবি, জীবনের কবি। তিনি ছিলেন স্বল্পায়ু। জীবনাভিজ্ঞতার শীর্ষে উপনীত না হয়েও তিনি জীবন নিয়ে কথা বলেছেন। সমাজের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক তা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। মানুষ তার সমতা এবং সৃজনশীলতা দিয়ে উন্নত বিশ্ব গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করুক ইকবাল তা চাইতেন। ইকবালের দৃষ্টিতে মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকেই এই বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত ছিল। ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্জাগরণ নামক গ্রন্থে তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন।

ইকবালের দৃষ্টিতে নবীজীর যে মেরাজ তা কেবল মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা) এর ই মেরাজ ছিল না,বরং এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে মানুষের পে আকাশের পর আকাশ পাড়ি দেওয়া সম্ভব এবং মহাশূন্য পাড়ি দেওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব। তারার মাঝে মানুষ যেন ভাগ্য খুঁজে না বেড়ায় সে কথা ইকবাল বলেছেন,তাঁর মতে তারাদের এমন কোনো শক্তি নেই যে মানুষের ভাগ্য সম্পর্কে খবর দেয়,বরং সে নিজেই মহাশূন্যে ভাসমান। ইকবালের মতে মানুষ তার কর্মকাণ্ড দিয়ে বিশ্বে তার ভাগ্য নির্মাণে সৃষ্টিশীল ভূমিকা রাখবে-এটাই স্বাভাবিক। মানুষ হবে আত্মনির্ভরশীল। সে তার রুটি-রুযির জন্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালাবে। কারণ মানুষের স্থান ফেরেশতাদের উর্ধ্বে।

মানুষ আল্লাহর সবচে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। তারা কোনো কারণ ছাড়া বা কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছাড়াই পৃথিবীতে এসেছে এমনটি গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষের জন্মের একটা কারণ অবশ্যই রয়েছে। মানুষকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। ইকবালের মতে মানুষের জীবন সুস্থির এবং প্রশান্ত হওয়া ঠিক নয়। মানব জীবন জুড়ে বিচিত্র চড়াই-উৎরাই থাকবে যাতে সেসব অতিক্রম করে যাবার জন্যে মানুষ তার মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে। জীবন হলো দ্বন্দ্বময় একটি ময়দান। চুপ করে থাকা বা আত্মসমর্পন করার নাম জীবন নয়। প্রকৃত জীবন হলো নিরন্তর উড়াল এবং ভ্রমণের আস্বাদ। স্পন্দনহীনতা মৃত্যুরই প্রতিশব্দ। মানুষ হলো মেধার ভাণ্ডার। আল্লাহ তাকে এই যে মেধা দিয়েছেন তাকে কাজে লাগিয়ে আত্মোন্নয়ন ঘটানো মানুষের কর্তব্য।


تو شب آفريدي ، چراغ آفريدم
سفال آفريدي، اياغ آفريدم
بيابان و راغ آفريدي
خيابان و گلزار و باغ آفريدم
من آنم كه از سنگ آئينه سازم
من آنم كه از زهر نوشينه سازم


তুমি সৃষ্টি করেছো রাত্রি,আমি করেছি বাত্তি
তুমি মৃত্তিকা বানিয়েছো আর আমি পেয়ালা
তুমি সৃষ্টি করেছো মরু প্রান্তর আর সবুজ বনানী
আমি বানিয়েছি রাস্তা আর ফুলেল বাগ-বাগিচা
আমি তো সে যে পাথর থেকে বানিয়েছে কাঁচ
আমিই তো সে যে বিষ থেকে বানিয়েছে মধু


ইকবাল তাঁর কবিতার পরতে পরতে মানুষের বিচিত্র গুণ এবং মেধার পরিচয় দিয়েছেন। তবে সেসবই গণমানুষের সাধারণ গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আদর্শ মানুষ বা ইনসানে কামেল বলতে ইকবাল ভিন্ন আরেকটি পরিচয় তুলে ধরেছেন। তিনি একমাত্র রাসূলে আকরাম (সা) কেই ইনসানে কামেলের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতায় এ বিষয়টি সহজলভ্য।


রেনেসাঁর কবি ইকবাল-(১২)

পাঠক! ইকবাল বিশেষজ্ঞ সাইয়্যেদ হাদি খসরুশাহী বলেছেন, 'ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে পড়া মুসলিম দেশগুলোতে মারাত্মক অচলাবস্থা সত্ত্বেও ইসলাম কীভাবে তার কালজয়ী আদর্শ দিয়ে, মেধা দিয়ে, প্রতিভা দিয়ে বৃহৎ অন্তরগুলোতে শক্তি জোগাতে হয় ইকবাল লাহোরী তা দেখিয়েছেন। ইসলামী সংস্কৃতি খুব ভালোভাবেই পারে মুসলমানদের সন্তানদেরকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে নিজের দিকে ফিরিয়ে আনতে। যেমন ইসলামী সংস্কৃতি মুসলিম জাতিকে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ভারতের এক যুবককে অর্থাৎ ইকবালকে উপহার দিতে পেরেছে।'

ইকবাল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পন্ন প্রতিশ্রুতিশীল কবি ছিলেন। তিনি মানবতার ব্যাপারে দায়িত্ব অনুভব করতেন। তিনি একদিকে যেমন আত্মগঠনের চিন্তা করতেন অপরদিকে মানুষকে পথ দেখানো এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বার চেষ্টা করতেন। তিনি উচ্চ মানের কবিতা ছাড়াও দার্শনিক চিন্তা এবং আধুনিক চিন্তা-চেতনার ধারক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শনকে তিনি ভালোভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। তারপরও তাঁর ব্যক্তিগত লেখাজোখায় যে দর্শন গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে,তা হলো ইসলামী দর্শন। আর এই ইসলামী দর্শনের সাথে পাশ্চাত্য দর্শনের ব্যাপক ব্যবধান রয়েছে।

ইসলাম কবি ইকবালের চিন্তা-চেতনায়,লেখাজোখায়,মন ও মননে এক কথায় তাঁর জীবনের সকল পর্যায়ে গভীরভাবে শেঁকড় বিস্তার করেছে। তাঁর কাছে সমগ্র মানব জাতির জন্যে ইসলামই একমাত্র উপযুক্ত জীবনাদর্শ। ইসলাম কোনো বিশেষ জাতি-দেশ বা গোষ্ঠির জন্যে নয় বরং সমগ্র বিশ্বের সকল মানবগোষ্ঠির জন্যে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইকবালের চিন্তা-দর্শন এবং তাঁর সাহিত্যের সাথে সম্যক পরিচিত। ইকবালের এইসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি মনে করেন-ইকবালের বিষয়টা কেবল ভারতেরই নয় বরং সমগ্র প্রাচ্য এবং মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পৃক্ত।

'প্রাচ্যবাসীর তাহলে কী করণীয়?' নামক গ্রন্থে দেখা গেছে' জুলুম অত্যাচার পীড়িত জনগোষ্ঠী কীভাবে জীবন যাপন করছে সেসব ব্যাপারে তিনি ওয়াকিফহাল এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের ব্যাপারে তিনি সচেতন। ইকবাল কেবল ভারতেরই নন কেননা তাঁকে যদি একজন সমাজ সংস্কারকও বলা হয় তাহলেও তাঁর সকল বৈশিষ্ট্যের কথা না বলাই থেকে যায়।

ইকবালের দৃষ্টিতে মানব মুক্তির একমাত্র পথ হলো ধর্মকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরা। আর তা সম্ভব হবে কেবল নিজেকে জানার মাধ্যমে। ইকবালের মতে এই নিজেকে চেনার মাধ্যমে আল্লাহকে চেনার পথ এবং আধ্যাত্মিকতার সত্য-সঠিক পথের সন্ধান মেলে। নিজেকে চেনার বিষয়টি ইকবাল লাহোরীর চিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দু। এই নামে তিনি একটি বইও লিখেছেন। বইটির নাম হলো 'আসরারে খুদি ও রমুযে বেখুদি'। ইকবাল তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে প্রাচ্যের মুসলিম জাতির বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন এবং তাদেরকে পাশ্চাত্য রাজনীতি,অর্থনীতি এবং চিন্তার দৈন্যতা থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

তিনি মনে করতেন মুসলমানদের উচিত সবকিছুর আগে নিজেকে চেনা এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়া। আর নিজেকে চেনার জন্যে কোরআন এবং সুন্নাতের অনুসরণ করতে হবে। সেইসাথে নিজের আত্মাকে সকল প্রকার পংকিলতা,মন্দকাজ এবং শারীরিক ও মানসিক দূষণ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। তাঁর মতে মুসলমানের সকল কাজ কর্মের ল্য হওয়া উচিত আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত রাখা,আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া এবং মুসলমানদের মাঝে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা।

ইকবালের যেই খুদি দর্শন তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং যারা পাশ্চাত্য দর্শনে বুঁদ হয়ে আছে তাদের চিন্তায় পরিবর্তন আনা। তিনি ইসলামের প্রাচীন গৌরব ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা এবং শান্তিপূর্ণ ইসলামী শাসনের উল্লেখ করাটাকেও মুসলমানদের মুক্তির উপায় বলে মনে করতেন। ইসলামী শাসনকেই তিনি মুসলমানদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবার উপায় বলে মনে করতেন।

রেনেসাঁর কবি ইকবাল-(১৩)

পাঠক! গত আসরে আমরা বলেছিলাম যে,ইকবালের দৃষ্টিতে মানব মুক্তির একমাত্র পথ হলো ধর্মকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরা। আর তা সম্ভব হবে কেবল নিজেকে জানার মাধ্যমে। ইকবালের মতে এই নিজেকে চেনার মাধ্যমে আল্লাহকে চেনার পথ এবং আধ্যাত্মিকতার সত্য-সঠিক পথের সন্ধান মেলে। নিজেকে চেনার বিষয়টি ইকবাল লাহোরীর চিন্তার মূল কেন্দ্রবিন্দু। ইকবাল তাঁর বহু রচনায় এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন যে,মুসলিম জাতির জন্যে নবীজীর অনুসরণ একটি অনিবার্য বিষয়। সর্বপ্রকার চিন্তা-ভাবনায় তাঁরি অনুসরণ করা উচিত। ইকবালের চিন্তা-চেতনা বা প্রবণতা আধ্যাত্মিক। অপরাপর আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের মতো কবি ইকবালও মনে করেন অন্তরই হলো আল্লাহর ফয়েজ বা অনুগ্রহ লাভ করার কেন্দ্র।

چه مي پرسي ميان سينه دل چيست
خرد چون سوز پيدا كرد، دل شد
دل از ذوق تپش دل بود، ليكن
چو يك دل از تپش افتاد گل شد

বরে মাঝে অন্তর কী জানতে চাও!
যুক্তি বা বুদ্ধিমত্তা জ্বলেপুড়ে হলো অন্তর
সে ছিল হৃদয়ের স্পন্দনে স্পন্দিত,কিন্তু
যখন পড়ে গেল নীচে ,কাদা হয়ে গেল

ইকবাল তাঁর সকল লেখাতেই সেই সূফিবাদের বিরোধিতা করেছেন, যেই সূফিবাদ জীবন থেকে পলায়নের কথা বলে। না, কেবল বিরোধিতাই করেন নি বরং তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। কেননা তিনি বিশ্বাস করতেন জীবন থেকে পলায়নকামী সূফিবাদ মুসলমানদের অবয়ের দিকে নিয়ে যায় এবং রাসূলে খোদার নীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

ইকবালের অধ্যাত্মবাদ ছিল সামাজিক। তাঁর দৃষ্টিতে সামাজিক জীবনের স্বরূপকে যে উপো করে কিংবা গুরুত্বহীন মনে করে সে সমাজচ্যুত হবার উপযুক্ত। সে কারণেই সূফিদেরকে অর্থাৎ যারা খানকায় অবস্থান করা বা ঘরকুনে থাকার বিষয়টিকে প্রচার করে বেড়ায় তাদেরকে ইকবাল ভর্ৎসনা করেছেন। ইকবালের মতে ইসলাম তার আবির্ভাবকাল থেকেই একটা সামাজিক,পার্থিব এবং দৈশিক ধর্ম ছিল। কোরআনে বর্ণিত যেসব নীতি বা অধিকারের কথা রয়েছে,তাতে মানব জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতি এবং মানুষের পূর্ণতার ব্যাপারে নিশ্চয়তা রয়েছে।

ইকবাল পাশ্চাত্য দর্শনের অনুকরণ করাকেই মুসলিম জাতির অবয় বা অচলাবস্থার কারণ বলে মনে করেন। ইসলাম হলো ধর্মীয় এবং নীতি-নৈতিকতার সংকলন। কেবল তাই নয় ইসলাম হলো মানুষের সামাজিক জীবনের জন্যে একটি পরিপূর্ণ আদর্শ। ইসলাম সর্বকালীন অর্থাৎ সর্বকালেই এবং পৃথিবীর সর্বত্রই এই ধর্ম মানুষের সার্বিক জীবনের সমস্যা সমাধানের জন্যে উপযোগী। ইকবাল মানুষের গড়া সকল মতাদর্শ যেমন পুঁজিবাদ,সমাজতন্ত্র,জাতীয়তাবাদ ইত্যাদিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এইসব মতবাদ মানুষকে একে অপরের কাছ থেকে আলাদা করেছে এবং মানবতার ভিত্তিমূলে এইসব মতবাদ ফাটল ধরিয়েছে।

ইকবাল ইসলামকে সার্বজনীন একটি জীবন বিধান বলে মনে করতেন। ইসলাম কোনো একটি গোত্র , গোষ্ঠি বা জাতির কিংবা কোনো নির্দিষ্ট ভাষাভাষী লোকজনের ধর্ম নয়। বরং ইসলাম হচ্ছে বিশ্বমানবতার মুক্তির ধর্ম। তাই ইসলামের কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই,ইসলাম বিশ্বজনীন। ইকবাল কেবল মুসলিম ঐক্যকেই ইসলামী শাসনের মূল ভিত্তি বলে মনে করেন। পবিত্র কোরআন এবং রাসূলে খোদার নির্দেশনায় ঐক্যের যে শিক্ষা রয়েছে তাই পারে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে। কারণ ইসলামের শিক্ষা সবসময়ই মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক অনৈক্যের পথকে রোধ করেছে। তবে নতুন করে ইসলামী ঐক্যের যে আদর্শের কথা বোঝানো হচ্ছে তা পাশ্চাত্য এবং ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে। খ্রিষ্টিয় উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সাইয়্যেদ জামালুদ্দিন আসাদাবাদী এই ঐক্যের ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছিলেন। ইকবাল যখন জামালুদ্দিন আসাদাবাদীর ইসলামী ঐক্য বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে পরিচিত হলেন,তখন তিনি জামালুদ্দিনের ঐ চিন্তার প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। জামালুদ্দিনের আসাদাবাদীর ইসলামী ঐক্যের ঝাণ্ডা কবি ইকবাল ভারতে ওড়ালেন।

ইকবাল সবধরনের বর্ণবাদকে ঘৃণা করতেন এবং এই বর্ণবাদকে তিনি যুদ্ধ-সংগ্রামসহ সকল প্রকার মন্দ কাজের কারণ বলে মনে করতেন। কবি ইকবাল সূরা এখলাসের ব্যাখ্যা শিরোনামে লেখা একটি কবিতায় সকল মুসলমানকে ঐক্যের আহ্বান এবং নিজেদের মধ্যকার মতবিরোধ দূর করারও আহ্বান জানান। কারণ তিনি ঐক্যকে সমগ্র মানবতার বিশেষ করে মুসলমানদের মুক্তির একমাত্র পথ বলে মনে করতেন।

آنكه نام تو مسلمان كرده است
از دوي سوي يكي آورده است
خويشتن را ترك و افغان خوانده اي
واي بر تو آنچه بودي مانده اي

দ্বৈতের লক্ষ্য একমুখী বলে
তুমি মুসলমান শিরোপা পেলে
নিজেকে বলো যদি তুর্কি কিবা আফগান
হায়রে কপাল,পূর্বাবৎ তুমি অপরিবর্তমান।


রেনেসাঁর কবি ইকবাল (১৪)

আধুনিক যুগে ইসলামী জাগরণ ও মুসলিম সমাজ সংস্কারের অন্যতম পথিকৃৎ আল্লামা ইকবালের চিন্তাধারার অন্যতম প্রধান দিক ছিল পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ইকবালের কবিতা ও লেখনীর সর্বত্র ফুটে উঠেছে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের প্রদীপ্ত এবং সাহসী উচ্চারণ। ইকবালের কবিতার বিশ্লেষকদের মতে ইসলামের প্রতি গভীর ও অবিচল বিশ্বাসের কারণেই ইকবাল পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঝান্ডা নির্ভিক চিত্তে উঁচু করে তুলে ধরতে পেরেছিলেন।

আল্লামা ইকবাল বিভিন্ন উপলক্ষ্য বা প্রাসঙ্গিকতার সুযোগে তাঁর কবিতা ও লেখনীতে পাশ্চাত্যের প্রতি কষাঘাত হেনেছেন। এই কষাঘাত শুধু আধুনিক বা সমসাময়িক যুগের পাশ্চাত্যের ওপর হানা হয় নি। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের পাশ্চাত্যও ইকবালের যৌক্তিক ও ক্ষুরধার লেখনীর আঘাতে জর্জরিত হয়েছে। প্লেটো ও সক্রেটিসের দর্শন চিন্তার কঠোর সমালোচনা করে ইকবাল বলেছেন যে এই দুই গ্রীক দার্শনিকের দর্শন চিন্তাবিদদেরকে বিশ্বের বাস্তবতার উপলব্ধি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। অবশ্য প্লেটো ও সক্রেটিসের দর্শন শুধু যে ইকবালই প্রত্যাখ্যান করেছেন তা নয়। বিশ্বের সমস্যাগুলোর সমাধানে এবং বিশ্বের বাস্তবতা তথা সত্যগুলোর উন্মোচনে এ দুই গ্রীক দার্শনিকের দর্শনসহ গ্রীক দর্শনের ব্যর্থতার কথা আরো অনেক মনীষীও বলেছেন। প্রাচ্যের দর্শন এবং ইসলামী এরফান বা আধ্যাত্মিক রহস্যের জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তিরা জানেন যে, সত্য বা বাস্তবতাকে পাবার একমাত্র পথ হলো আত্মশুদ্ধি। আরেফদের মতে, সত্যসন্ধানীর বা সত্যপিপাসুর পরিশুদ্ধ আত্মাতেই ঐশী বা খোদায়ী নূর প্রতিফলিত হয় এবং এর ফলে গুপ্ত জ্ঞান তাঁদের কাছে হয় প্রকাশিত । তাই এটা খুবই স্বাভাবিক যে, প্রাচ্যের দর্শন ও ইসলামী এরফান সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকায় ইকবালও গ্রীক দর্শনকে নাকচ করে দেবেন।
দার্শনিক ও মহাকবি ইকবালের দৃষ্টিতে কেবল মহান আল্লাহর বিধান অনুসরণ এবং নবী-রাসূলদের দেখানো পথ বা শরীয়তের পথ ধরেই সত্য বা বাস্তবতা উপলব্ধি করা সম্ভব। এ জন্যেই তিনি লিখেছেন,

আল্লাহর দাস কোনো পদের মুখাপেক্ষী নন
কেউ নয় তার দাস, তিনিও কারো দাস নন
আল্লাহর বান্দা মুক্ত-স্বাধীন, আর এটাই তো যথেষ্ট
তার রাজ্য ও বিধান খোদাদত্ত, আর এটাই তো যথেষ্ট
তার প্রথা, ধর্মমত ও বিবি-বিধান উৎসারিত আল্লাহ হতে
তার ভালো-মন্দ, তিক্ততা বা মিষ্টতা তাও আসে আল্লাহ হতে
স্বার্থপরের মনে অন্যের উন্নতির চিন্তা থাকে না
নিজের লাভ ছাড়া অন্যের লাভ বা কল্যাণ সে দেখে না
কিন্তু ঐশী প্রত্যাদেশ দেখে সবারই স্বার্থ ও প্রগতি
এই দৃষ্টিতে রয়েছে সকলেরই কল্যাণ ও উন্নতি


পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে আল্লামা ইকবালের সংগ্রাম শুধু খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক বা গ্রীসেই সীমিত নয়। তিনি প্রাচীন যুগের পাশ্চাত্যের চেয়েও সমসাময়িক যুগের পাশ্চাত্যেরই বেশী সমালোচনা করেছেন। তার মতে সমসাময়িক যুগের পশ্চিমা চিন্তাভাবনাই বিশ্বের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। দার্শনিক ইকবাল পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণকে হারাম বা অবৈধ বলে মনে করতেন এবং বিজ্ঞানের অপব্যবহারে অভ্যস্ত পাশ্চাত্যের কোনো কোনো অগ্রগতিকে প্রতারণা বলে অভিহিত করেছেন। তিনি লিখেছেন,

ফিরিঙ্গীরা গড়ে তুলেছে অনেক আজব শিল্প-সম্ভার
একটি ফোটা দিয়ে গড়ছে জ্ঞান-সাগর অকূল-পাথার
কিন্তু এসব জ্ঞানই সীমিত মানুষ মারার চিন্তায়
পাশ্চাত্যের সমস্ত জ্ঞান-কৌশল মৃত্যুর সেবক
পাশ্চাত্যের বন্দুকের প্রাণহরণের দক্ষতায়
মৃত্যুর ফেরেশতাও ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়

মুসলমানদের মধ্যে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রচলন পাশ্চাত্যের বিরোধীতায় ইকবালের সোচ্চার হবার অন্যতম কারণ । তিনি বিভিন্ন উপলক্ষে ও সুযোগমত নানা পন্থায় পশ্চিমা সংস্কৃতির সর্বনাশা প্রভাব সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক করার চেষ্টা কোরেছেন। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিরোধ ছিল তার অন্যতম উদাত্ত আহ্বান। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন,

ফিরিঙ্গীদের শক্তি তো জ্ঞান আর প্রযুক্তির
এ আগুনেই তাদের মশাল জ্বলজ্বল
জ্ঞান ও প্রযুক্তি মগজে ধারণ করো হে যুবক প্রাণোচ্ছল
হয়ো না অনুসারী পোশাকে-আশাকে ফিরিঙ্গির

মুসলিম দেশগুলোর শোচনীয় পরিস্থিতি এবং অনেক মুসলিম দেশে পাশ্চাত্যের উপনিবেশ পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে সংগ্রামী হতে ইকবালকে প্রেরণা যুগিয়েছে। উপনিবেশবাদীরা মুসলমানদের সাথে খারাপ ও নির্দয় আচরণ করতো এবং তাদেরকে অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতো। মুসলমানদের ওপর গণহত্যা ও তাদেরকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা এবং তাদের পবিত্র বিষয়গুলোর অবমাননা ছিল পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের নিয়মিত কর্মসূচী। অন্যান্য চিন্তাবিদদের মতো ইকবাল এসব দেখে-শুনে ক্ষুব্ধ ও ব্যাথিত হয়েছিলেন। তাঁর মতে, মুসলমানদেরকে এসব দূর্দশা থেকে মুক্ত করার একমাত্র পথ ছিল সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা। ইসলামের অনুসরণ থেকে দূরে সরে যাবার কারণেই মুসলমানদের এতো দূর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে বলে ইকবাল মনে করতেন। তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

মুসলিম আজ চেনে না তার নবীকে
আল্লাহর ঘর আবার ভরে গেছে মূর্তিতে
ভরেছে লাত, মানাত, ওজ্জা আর হোবলে
ওরা আছে মুসলমানের বগলে

ইকবাল শুধু পাশ্চাত্যেরই সমালোচনা করেন নি। একইসাথে তিনি জুলুম মেনে নেয়ার জন্য প্রাচ্য এবং বিশ্বের উত্তর ও দক্ষিণাংশেরও সমালোচনা করেছেন। তবে তার মূল লড়াই ছিল পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে। কারণ, তার মতে পাশ্চাত্যই সারা বিশ্বে দূর্নীতি ও হানাহানি ছড়িয়ে দিচ্ছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা ও দূর্বল বা বঞ্চিতের সহায়তায় এগিয়ে আসার লক্ষ্যে তিনি লিখেছেন,

ফেরাউনদের কাছে বলো সাহসী কথা মুসার মত
যাতে তোমার লাঠিও দরিয়াকে করে দ্বিখন্ডিত
এভাবে দেখা যায় মুসলিম জাহানের উন্নতিই ছিল ইকবালের প্রধান চিন্তা। তাঁর কবিতাতে সব মুসলিম দেশের নাম উচ্চারিত হয়েছে একান্তই নিজের দেশ হিসেবে। প্রত্যন্ত মুসলিম অঞ্চলের দুঃখ-বেদনাও ছিল যেন তাঁর নিজেরই দুঃখ-বেদনা। তিনি প্রত্যেক মুসলিম জনপদকেই পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছিলেন। #

রেনেসাঁর কবি ইকবাল-(১৫)

আধুনিক যুগে মুসলিম জাগরণের অন্যতম নকীব ও স্বপ্নদ্রষ্টা আল্লামা ইকবাল লাহোরীর চিন্তার জগত এবং দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব তিনি শুধু নিজ জাতি তথা মুসলমানের কল্যাণ নিয়েই ভাবেন নি। গোটা মানব জাতির মুক্তি ছিল তার অন্তরের আকুতি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র আদর্শ তথা ইসলাম যে গোটা মানব জাতির জন্য মুক্তির একমাত্র পথ সেটা তুলে ধরতে গিয়েই তিনি ইসলামী আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমা তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছেন । একজন প্রকৃত কবি হলেন সত্যের বাগিচার বুলবুল এবং সত্য তুলে ধরাই তার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আর ইসলামই যে মানব জাতির জন্য সবচেয়ে বড় সত্য তা ফুটিয়ে তোলাই ছিল আল্লামা ইকবালের সমস্ত লেখনী ও চিন্তাধারার মূল উদ্দেশ্য । আর এদিক থেকে আমরা বিশিষ্ট দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালকে বিশ্ব মানবতার কবি বলেও উল্লেখ করতে পারি।

যা কিছু সত্য, সুন্দর, কল্যাণকর ও মঙ্গলময় ইসলামের সাথে তার কোনো দ্বন্দ্ব বা সংঘাত নেই, বরং ইসলাম থেকেই সমস্ত সত্য, সুন্দর ও কল্যাণকর বিষয় উৎসারিত হয়েছে। ইসলামের অন্য অনেক মহান ব্যক্তিত্ব বা মনীষীর মতো মহাকবি ইকবালও তার লেখনীতে এ বিষয়টি তুলে ধরতে চেয়েছেন। ইউরোপে গীর্যার শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা হবার পর ইকবাল এই বিপ্লবের ইতিবাচক দিককে স্বাগতঃ জানিয়ে লিখেছিলেন:

বস্তুবাদী রুশ পরে ঐশীবাণী হয়েছে নাজেল
লাৎ ও মানাৎ যত গীর্যার আজ ভেঙ্গে ফেল

গীর্যার রাষ্ট্রীয় শোষণের যুগ শেষ হবার পর পাশ্চাত্য ধর্মনিরপেক্ষতার ধুয়া তুলে ধর্মকে পুরোপুরি নির্বাসন করায় ইকবাল এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা করার প্রতিবাদ জানিয়ে ইকবাল বলেছেন, রাজনীতি থেকে ধর্মকে বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে শুধু চেঙ্গিস খানের হৃদয়। রাজনীতি ও ধর্মকে আলাদা করার নীতিতে বিশ্বাসী পাশ্চাত্য দু-দটি বিশ্ব যুদ্ধ ছাড়াও দেশে দেশে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা ও গণহত্যা চালিয়ে ইকবালের ঐ মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ কোরেছে।
অন্যদিকে অর্থ ও বিত্তকে পুঁজি কোরে প্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদের ভিত্তিতে পাশ্চাত্যে যে গণতন্ত্র প্রচলিত ইকবাল সে গণতন্ত্র পরিহার করতেও বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি পাশ্চাত্যের কথিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রকে খোলা বা নাঙ্গা তলোয়ার বলে অভিহিত করেছেন। ইউরোপীয় দর্শন ও মতবাদগুলোর সাথে ভালোভাবে পরিচিত আল্লামা ইকবাল পাশ্চাত্যের স্ববিরোধী চিন্তাগুলোর সমাধান হিসেবে ইসলামকেই মানব জাতির কাছে পেশ করে গেছেন। তার দৃষ্টিতে পাশ্চাত্য মানবিকতার সাথে জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তিত্ববাদের সাথে সমাজতন্ত্র এবং মনোবিজ্ঞানের সাথে জড়বিজ্ঞানকে জড়িয়ে সর্বগ্রাসী এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি কোরেছে। পাশ্চাত্যে শিল্প বিপ্লব ও জ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির মুখে মুসলমানদের অনেকেই যখন হতাশায় ভুগছিল তখন ইকবাল মুসলমানদের নব-উত্থান বা অভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ কবি প্রথমেই মুসলমানকে তার আন্তর্জাতিক ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। মুসলমানরা যে কোনো দেশের গন্ডীতে আবদ্ধ নয় তা তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলেন। জাতীয়তাবাদ যে মানবিকতার বৃহত্তর দায়িত্ব পালনে অক্ষম এবং মানবতার জন্য মারাত্মক সে কথা তুলে ধরে তিনি বললেন,

সব দেবতার সেরা সে-দেবতা যাহারে কহিছ স্বদেশ ফের,
বসন তারি বনেছে কাফন আবরি' বদন ইসলামের।

মুসলামানদেরকে জাতীয়তাবাদের মূর্তি ভাঙ্গার আহ্বান জানিয়ে ইকবাল আরও বলেছেন,

পুরাতন সেই দৃশ্য আবার নতুন যুগেরে দেখিয়ে দাও,
মুসলিম যদি হতে চাও তুমি তবে এ নতুন মূর্তিরে গুড়িয়ে দাও

ইসলামের আন্তর্জাতিক ও বিশ্বজনীন গুণে গুনান্বিত হবার জন্য স্থান ও কালের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ইকবাল বলেন,

অগ্রসর হও তুমি গিরি বিদারিয়া
স্থান ও কালের গুঢ় রহস্য ভেদিয়া।

 দার্শনিক কবি ইকবালের মতে ইসলাম মানব জাতিকে যেসব গাইড লাইন দিয়েছিল চৌদ্দশ বছর আগে মানুষ আজো তা নিজের মধ্যে রূপায়িত করতে পারে নি। কিন্তু ইউরোপ বিজ্ঞানের উন্নতি ও বিচিত্র চিন্তার উপকরণ দিয়ে ইসলামের নব অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র বা জমিন তৈরি করে দিয়েছে। কারণ, পাশ্চাত্যের ল্যাবরেটরীগুলোতে উদ্ভাবিত বিভিন্ন মতবাদ মানব জাতির সমস্যাগুলোর সমাধান করতে না পারায় বিশ্বমানবতা যে ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়বে ইকবাল তা বুঝতে পেরেছিলেন। আধুনিক সভ্যতার সংকট এবং মুক্তির জন্য মানব জাতির আকুলতা তুলে ধরতে গিয়ে ইকবাল লিখেছেন,

বুদ্ধি আজো বল্গাবিহীন/ প্রেম ওযে খোঁজে প্রকাশ তার,
অনন্ত তব সৃষ্টি হে প্রভু, আজো মুখ চেয়ে পূর্ণতার।
তুচ্ছ প্রকৃতি-ভ্রুকুটি তলে/ আজো জড়সড় মানুষ হায়,
তোমার জগতে তেমনি সন্ধ্যা/ তেমনি প্রভাত কাঁদিয়া যায়।
তোমার ধনীরা ধনেতে মত্ত/ ফকির বিভোর আপনা মাঝে,
দাস আজো রয় জীর্ণ কুটিরে/ উচ্চ প্রাসাদে সুখীরা রাজে
বুদ্ধি, ধর্ম, জ্ঞান ও শিল্প/ আজো কামনার অধম দাস,
যেই প্রেম খুলে হৃদয়-বাধন/ কাঁদে জনগণ তাহারি আশ

ইসলামী রেনেসাঁ বা পুণর্জাগরণের কবি ইকবাল তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষা পুণরুজ্জীবনের চেষ্টা কোরছেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষা বা চিন্তা পুণরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে ইসলামের মূল নীতিমালাকে নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষপাতি ছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য নিবেদিত এই মহৎ-প্রাণ কবি আধুনিক যুগের সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজতেন ইসলাম ও পবিত্র কোরআনের বাণী থেকে। আল্লামা ইকবালের দৃষ্টিতে ইসলামের বাণী ছিল সূর্যের মতো প্রদীপ্ত, যে ইসলাম এক সুষ্ঠ সামাজিক ব্যবস্থা, যা কর্ম, সুবিচার, সাম্য, ভাতৃত্ববোধ ও মানবিকতার প্রকাশস্থল। যে মুসলমান গুণে নয় শুধু নামে মুসলমান সে মুসলমানকে তিনি ঘৃণা করেছেন, দিয়েছেন অভিসম্পাত। তিনি বলেছেন, মুসলমান কতগুলো মহান গুণের ধারক, সেসব গুণ যার মধ্যে দেখা দেবে, সে-ই বিশ্বপ্রভুর সাহায্য লাভে ধন্য হবে। তার দৃষ্টিতে মুসলমানের নামের অধিকার আসলে এক অসার আত্মপ্রচার। তাই তিনি লিখেছেন,

কি বললে তুমি? মুসলিমের তরেই শুধু হুরের অঙ্গীকার?
অভিযোগ তব মিথ্যার বেসাতি, কান্ডজ্ঞানের ধারো না ধার?
সুবিচার সে যে প্রকৃতির রীতি, প্রকৃতি খেলাপ করে নি তার,
কাফের লভিল হুর গিলমান মুসলিম নীতি করিয়া সার।
স্বর্গপূরীর সুন্দরী হুর তোমরাই কেউ চাও না আজ
তূরের দীপ্তি তেমনি উজল, মূসা তো পরে না প্রেমিক সাজ।

মহাকবি ইকবাল মনে করতেন মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা ও আধ্যাত্মিক অগ্রগতির জন্য বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরী। আর এ জন্য প্রয়োজন মারেফাত বা গভীর জ্ঞান অর্জন। তার মতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের মাধ্যমে আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানও পরিপূর্ণতা পায়। ইকবাল অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতা, ইতিহাস ও প্রকৃতিকে জ্ঞানের তিনটি মূল ভিত্তি বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী অনুভূতি, বিবেক ও আত্মিক উপলব্ধি গভীর জ্ঞান বা মারেফাত অর্জনের মাধ্যম। আর মানুষের গভীর জ্ঞানের কেবল একটি অংশ বাহ্যিক জ্ঞান থেকে আসে, কিন্তু এর বেশীর ভাগই আত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে অর্জিত হয়।
ইকবাল মনে করতেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানে পরিপূর্ণতা অর্জনের পরই একজন আরেফ মহাপ্রভুর সান্নিধ্য পান। কিন্তু শুধু বাহ্যিক বা জাগতিক জ্ঞানের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সেই সান্নিধ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না। তবে এ দুই ধরনের জ্ঞানকে তিনি পরস্পরের পরিপূরক বলে অভিহিত করেছেন। বিশেষ করে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পাশাপাশি দর্শন ও বিজ্ঞানকেও গভীর জ্ঞান বা মারেফাত অর্জনের পন্থা বলে মনে করতেন । অন্য কথায় তিনি এই দুই ধরনের জ্ঞানকে সাংঘর্ষিক বলে মনে করতেন না। অবশ্য ইকবাল আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ইসলামী দর্শনকে সাধারণ বিজ্ঞান ও আক্বলের চেয়ে উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।
আল্লামা ইকবাল মনে করতেন ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বা খালি চোখে যে জ্ঞান অর্জিত হয় মনের চোখ ও আত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে তা গভীরতর করা যায়। কারণ, অজ্ঞাত ও রহস্যময় বিষয়গুলোকে অন্তরের চোখ দিয়ে দেখে দূরদর্শিতা অর্জন করা সম্ভব। ইকবালের দৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের আধুনিক জ্ঞানের একটি সমস্যা হলো এই জ্ঞান মানুষকে মানুষের মতো জীবন যাপনের শিক্ষা দেয় না। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে বিভিন্ন বৈষয়িক সংকীর্ণ স্বার্থে অপব্যবহার করার প্রবণতায় তিনি গভীর উদ্বিগ্ন ছিলেন। আর এ জন্যেই তিনি প্রাচ্যের প্রেম-সন্ধানী মন নিয়ে সত্যকে জানার এবং পশ্চিমা তত্ব বা মতবাদগুলোকে মন থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন। অবশ্য ব্যবহারিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি ছাড়া মুসলমানদের জাগতিক উন্নতিও যে সম্ভব নয় ইকবাল তাও উল্লেখ করতে ভুলেন নি। তার মতে পবিত্র কোরঅান মানুষকে ব্যবহারিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত কোরেছে। অথচ মুসলমানরা এ দিকেও অচেতন হয়ে রয়েছে। অন্য কথায় ইকবাল জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সমন্বয় তথা এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেই মুসলিম উম্মাহকে জেগে উঠতে বলেছেন। এক্ষেত্রে যে কোনো একটির দিকে বেশী ঝুঁকে পড়া তার কাম্য ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে এ ভারসাম্য আনার জন্যেই সুফীর উদ্দেশ্যে শীর্ষক কবিতায় তিনি লিখেছেন,

নয়ন তোমার দেখিছে স্বপন অতি-প্রাকৃতের দুনিয়া মাঝে
মোর চোখে এই বস্তুপুঞ্জ ঘটনাধারার বিশ্ব রাজে!
মনে মোর কোনো সন্দেহ নেই, বিশ্ব তোমার চির উজল,
আমি বলি শুধু, জীবন-মৃত্যু-ঢেউ-তোলা ধরা নহেকো ছল।
তোমার দৃষ্টি রচিবে হেথায় অভূতপূর্ব রূপান্তর,
যদি তার আলো পড়ে আসি আহা, দুনিয়ার এই বস্তু'পর।

অন্যদিকে শুধু নীরস যুক্তির চর্চা করে আল্লাহকে পাওয়া বা পরম সৌভাগ্য অর্জন করা যে সম্ভব নয় তাও দৃঢ়তার সাথে জানিয়ে গেছেন ইসলামী রেনেসাঁর কবি ইকবাল। তার মতে হাজারও যুক্তির পথ দিয়ে বা বাহ্যিক জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে আল্লাহকে যতটা উপলব্ধি করা যায়, এক মুহুর্তের খোদা-প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসার আরো গভীর স্তরে পৌঁছানো যায়।
মোটকথা ইসলামী জাগরণ ও বিশ্বমানবতার কবি ইকবাল মানব জাতির মুক্তির জন্য মানুষকে ইসলাম সম্পর্কে চিন্তাভাবনার বুদ্ধিদৃপ্ত পথে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে তিনি মুসলমানদেরকে সত্যিকারের মুসলমান হবার জন্য পথ নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। খোদাপ্রেম থেকে উদ্ভুত গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞান, ন্যায়বিচার, ঈমান, ঐক্য ও মানব-প্রেমই যে মুসলমানের বড় পরিচয় সে কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলেন নি যুগ-সংস্কারক এই মহান মুসলিম কবি। ( সমাপ্ত ) #

0 comments:

Post a Comment

 
Copyright © . A-Tasauf is the holy place of Mind . - Posts · Comments
Theme Template by BTDesigner · Powered by Blogger