Friday, May 17, 2013

মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি (১-১০পর্ব)

মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি (১-১৫পর্ব)


বিশ্বের সমৃদ্ধতম সভ্যতাগুলোর একটি হচ্ছে মুসলিম সভ্যতা। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এই সভ্যতার উৎপত্তি হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। মুসলিম সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে যুক্তির উপর ভিত্তি করে। মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও বেশি আলোচনার লক্ষ্যে আমরা নতুন এই ধারাবাহিকের আয়োজন করেছি। এই ধারাবাহিকে মুসলিম সভ্যতার বিকাশ, চড়াই-উৎরাই এবং এ সভ্যতা বিকাশের পথ-পরিক্রমা সম্পর্কে আলোচনা স্থান পাবে।
প্রথম পর্ব

ইসলাম ধর্ম বিশ্বকে এমন এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে যা গোটা মানব জাতি বিশেষ করে মুসলমানদের চীর ঋণী করে রেখেছে। কিন্তু সমৃদ্ধ এই মুসলিম সভ্যতার অবদান সম্পর্কে বর্তমান তরুণ সমাজ খুব একটা অবহিত নয়। এ কারণে তরুণ সমাজসহ বিশ্বের জ্ঞান অন্বেষীদের জন্য মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে তুলে ধরার অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। নিজের অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাও প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নিজের পূর্বসুরীরা সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে কোন পর্যায়ে এবং কোন অবস্থানে ছিলেন, সে সম্পর্কে জানতে পারলে সামনের দিকে পথচলা আরও সহজতর হয়। এছাড়া, নিজের অতীত সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান নয়া প্রজন্মের মানুষের ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতি গঠনে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপনিবেশবাদীরা গত দুই শতাব্দী ধরে সব সময় বিশ্বের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠী বিশেষকরে মুসলমানদের মৌলিকত্ব, মর্যাদা ও কর্মক্ষমতাকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। উপনিবেশবাদী পাশ্চাত্য, বিশ্ববাসীকে এটা বুঝানোর চেষ্টা করছে যে, পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে ধারন করা ছাড়া অন্যদের আর কোন উপায় নেই।

প্রাচ্যের দেশগুলোর সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করার পেছনে পাশ্চাত্যের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, প্রাচ্যের দেশ ও জাতিগুলোর নানা অর্জনকে অস্বীকার করে তাদের সব উন্নয়ন, অগ্রগতি ও অর্জনকে নিজেদের অর্জন হিসেবে তুলে ধরা। পাশাপাশি মুসলমানদের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ঠেকানোও তাদের অশুভ উদ্দেশ্যের অংশ। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাফিয়ী সার্বেস্তানি মনে করেন, পশ্চিমারা বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপন করে উন্নত প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং এখন তারা এই প্রযুক্তি ও শক্তি দিয়ে গোটা বিশ্বে নিজেদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। পাশ্চাত্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে পাচ্যের উপর নিজেদের রীতি-নীতি ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।

পাশ্চাত্য নিজেদের ভূখণ্ডকে মানব সভ্যতার লালন ক্ষেত্র হিসেবে তুলে ধরার পাশাপাশি অন্যদের উপর নিজেদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাদের এসব অপতৎপরতা মোকাবেলার জন্যে ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংঘাতের তত্ত্ব প্রদানকারী মার্কিন তাত্ত্বিক স্যামুয়েল হান্টিংটন এটা স্বীকার করেছেন যে, পাশ্চাত্য, বিশ্বকে নয়া সমাজ ব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন সভ্যতার মানুষকে পাশ্চাত্যপন্থী হিসেবে গড়ে তুলছে। তার মতে, এর ফলে তারা নিজেদের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও অভ্যাস ত্যাগ করে পাশ্চাত্যকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করছে।

বর্তমানে পশ্চিমারা মুসলিম সভ্যতার উন্নতি ও উৎকর্ষ বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য সুসংহত করার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকেই পাশ্চাত্য বিশ্বের নেতৃত্ব পুরোপুরি করায়ত্ত করার নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে। কোন কোন দেশ ও জাতি এ ধরনের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি না হওয়ায় পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করার কৌশল বেছে নেয়। বিশেষকরে তারা মুসলিম দেশগুলোতে সুকৌশলে ও ক্রমান্বয়ে পশ্চিমা-সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। তারা এটা ভালো করেই জানে যে, সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকলে রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা সহজতর হয়। মার্কিন গবেষক ও লেখক এডওয়ার্ড বার্মান বলেছেন, পশ্চিমারা, গণযোগাযোগ মাধ্যম, মিডিয়া এবং রকফেলার,কার্নেগি ও ফোর্ডের মতো বাহ্যত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উন্নয়নশীল সমাজে বিশেষ ধরনের চিন্তা-বিশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা এর মাধ্যমে বিশ্ব পরিস্থিতি ও জীবন সম্পর্কে মানুষের বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করছে।

আমরা নতুন এই ধারাবাহিকে মূলত মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করবো। কাজেই এখানে সংক্ষেপে মুসলিম সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার কারণ এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে এর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা দরকার। মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠার ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুসলিম সভ্যতা হচ্ছে জীবন্ত ও গতিময় এক সভ্যতা এবং এই সভ্যতা সময়ের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। আর এ ধরনের গতিময় সভ্যতা যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। মুসলিম সভ্যতাও শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও এমনকি বারবার বিজাতীয় আগ্রাসনের শিকার হবার পরও কখনোই পাশ্চাত্যের কাছে নতিস্বীকার করেনি। তাছাড়া, ইরানি, মিশরীয় ও আরব সংস্কৃতির মতো বিভিন্ন স্থানীয় সংস্কৃতিকে টিকে থাকার সুযোগ দেবার কারণে মুসলিম সভ্যতা ক্রমেই সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে সমৃদ্ধ হয়েছে। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতা সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে ধ্বংস করে সকল সংস্কৃতিকে একীভুত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে এটা সুস্পষ্ট যে, এখানে সকল সংস্কৃতিই গুরুত্ব পেয়েছে এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছে। মুসলিম সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রেও এই বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

মার্কিন ইতিহাসবিদ উইল ডোরান্ট সভ্যতা ও সভ্য সমাজের সংজ্ঞা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন," সভ্যতা হলো সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা, যা সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনী শাসন ও তুলনামূলক জনকল্যাণের মধ্য দিয়ে অস্তিত্ব লাভ করে। সভ্যতা হচ্ছে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সমুন্নিতর ফসল। আর যে সমাজ, সামাজিক শৃঙ্খলা সাধন করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মানুষের মর্যাদা বৃদ্ধির কথা ভাবে, সেই সমাজই সভ্য সমাজ।"
এটা নিশ্চিত যে, মুসলিম সভ্যতার গতিময়তার একটি কারণ হলো বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর অস্তিত্বকে মেনে নেয়া বা স্বীকৃতি দেয়া। মুসলিম সভ্যতায় জাতিগত বৈষম্যের কোন স্থান নেই এবং এটি কোন বিশেষ জাতি-শ্রেনীর সাথে সম্পর্কিত নয়। ইসলাম হচ্ছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধর্ম এবং ইসলাম এটা প্রমাণ করেছে যে, এই ধর্ম মানুষকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে পরিচালিত করতে পারে।

মুসলিম সভ্যতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, কুসংস্কার ও গোঁড়ামি থেকে দূরে থাকা। আরব বিশ্বে ইসলামের দাওয়াতী কাজ যখন শুরু হয় তখন সেখানকার মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। ইসলাম ধর্ম; জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ভিত্তিক যে শিক্ষা মানুষকে দিয়েছে,তা অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের শিকল ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করেছে। ইসলামী শিক্ষা, মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব জাগ্রত করার পাশাপাশি প্রাথমিক যুগেই সমুজ্জল মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠার ও তা বিকশিত হবার ক্ষেত্র তৈরী করেছিল। উইল ডোরান্ট তার সভ্যতার ইতিহাস শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, মুসলিম সভ্যতার মতো এত বিস্ময়কর সভ্যতা আর দ্বিতীয়টি নেই। ইসলাম যদি গতিময় না হতো এবং অন্যান্য সংস্কৃতিকে বিলীন করার চেষ্টা চালাতো তাহলে মুসলিম সভ্যতা আরব ভূখন্ডের গন্ডি পেরোতে সক্ষম হতোনা। এসব গুণাবলীর কারণেই ইসলাম এক শতাব্দীরও কম সময়ের মধ্যে অন্যান্য সভ্যতাকে আকৃষ্ট করে বিশাল এক সভ্যতায় পরিণত হতে সক্ষম হয়েছিল।

পবিত্র চিন্তা-চেতনার উপর ভিত্তি করেই মুসলিম সভ্যতা গড়ে উঠেছে। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতে পার্থিব জীবন ও ধর্মের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। ইসলাম মানুষের বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক উভয় দিককেই গুরুত্ব দেয়। ধর্ম হচ্ছে মানুষের পূর্ণতা ও উন্নতি সাধনের মাধ্যম এবং জ্ঞান ও বিবেকের সাথেও এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মুসলিম সমাজ-বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বিশ্বাস করতেন, মানুষের ধর্মীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিকগুলোর সাথে তার মানবিক দিকগুলোর সংযোগের মাধ্যমেই সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী সভ্যতা গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য, মুসলিম সভ্যতা অতীত সভ্যতাগুলোর নেতিবাচক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিকগুলোকে সব সময় প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ইতিবাচক দিকগুলোকে লালন করে পূর্ণতা লাভ করেছে এবং বিকশিত হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্ব

গত আসরে আমরা বলেছি, মানব সভ্যতায় ইসলাম ধর্মের অনস্বীকার্য ভূমিকা রয়েছে। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিজাতীয়রা মুসলিম সভ্যতার অর্জনগুলোকে উপেক্ষা করে মুসলমানদের নানা আবিস্কার ও অর্জনকে নিজেদের বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। গত পর্বে আমরা মুসলিম সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হবার মূল উপাদানগুলোর কোন কোনটি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, ইসলাম ধর্ম বিভিন্ন সংস্কৃতি ও জাতির অস্তিত্বকে মেনে নিয়েছে এবং গোঁড়ামি ও কুসংস্কারমুক্ত থাকার পাশাপাশি ধর্ম ও পার্থিব বিষয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে। এ পর্বে আমরা মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির চড়াই-উৎরাইয়ের নানা কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করবো।

মুসলিম সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা অন্যতম। লেবাননের খ্রীষ্টান লেখক জর্জি যেইদান বলেছেন, মদিনায় প্রবেশের পর রাসূল (সা.)'র প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলো, মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে সেখানে আগত মক্কী মুসলমানদের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই চুক্তিটিই ছিলো মুসলিম ঐক্যের প্রথম ভিত্তি,যা রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। জর্জি যেইদানের মতে, প্রথম থেকেই মুসলমানরা নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছে এবং এর ভিত্তিতে মুসলিম সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছে। ধর্ম ও নৈতিকতার সঙ্গে সভ্যতা ও সংস্কৃতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমুন্নত রাখতে এ দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্তমান যুগের বেশিরভাগ চিন্তাবিদ এ ব্যাপারে একমত যে, পশ্চিমা সভ্যতায় বিজ্ঞান ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটলেও নীতি ও আদর্শ এবং চারিত্র্যিক ক্ষেত্রে সেরকম কোন উন্নতি বা উৎকর্ষ অর্জিত হয়নি। এমনকি দিনদিনই এ অবস্থার অবনতি হচ্ছে। অনেক চিন্তাবিদের মতে, নৈতিক ও চারিত্যিঅবক দিকটি উপেক্ষিত হবার কারণে সৃষ্ট অবক্ষয়ের কারণেই পশ্চিমা সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতায় পরিণত হয়েছে।

পশ্চিমা সংস্কৃতির পতনের কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের নানা মত ব্যক্ত করেছেন। পাশ্চাত্যে রেনেসাঁর পর যেসব চিন্তাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে হিউম্যানিজম, লিবারেলিজম ও সেক্যুলারিজম-এই তিনটি মতবাদের উপর ভিত্তিশীল। হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদে মানুষ স্বাধীন এক অস্তিত্ব। এ মতবাদ অনুযায়ী, ঐশী দিক নির্দেশনার কোন প্রয়োজন মানুষের নেই। এছাড়াও পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি লিবারেলিজম বা উদার নৈতিকতাবাদের ওপর বিশ্বাসের কারণে এবং ব্যক্তি স্বার্থকে সব কিছুর উর্ধ্বে স্থান দেয়ায়, নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিকতাকে প্রত্যাখ্যান করছে। নৈতিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিকতা প্রত্যাখ্যান করার কারণে পশ্চিমা সমাজে বিশৃংখলা ও উচ্ছৃংখলতা বেড়ে চলেছে। পশ্চিমা সভ্যতার অপর ভিত্তিটি হলো, সেকুলারিজম বা ইহলৌকিকতাবাদ ও ধর্মহীনতা। এই মতবাদ রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের গুরুত্বকে অস্বীকার করে।

বর্তমানে পশ্চিমা দেশগুলোর সমাজে হিউম্যানিজম, সেক্যুলারিজম ও লিবারেলিজমের প্রভাব সুস্পষ্ট। মার্কিন লেখক বুকানান জে.পেট্রিক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কারণে পশ্চিমা সভ্যতায় ধর্মপরায়ন ও সম্মানিত ব্যক্তিদের উপর চরম দুর্দশা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, আর এ কারণেই এই সভ্যতা অগ্রহণযোগ্য ও ঘৃণ্য। পাশ্চাত্য সভ্যতার পেছনে যে আইডিওলোজি বা জ্ঞান-তত্ত্ব কাজ করছে তা মানব প্রকৃতির সাথেও সাংঘর্ষিক। পাশ্চাত্যে নৈতিক অবক্ষয় ও মানব জীবন থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করাও পাশ্চাত্য সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু হবার একটা অন্যতম কারণ। মি. বুকানানা তার বইয়ে লিখেছেন, ১৯৮৩ সালে হোয়াইট হাউস যখন চিকিৎসা সংকট নিয়ে আলোচনায় মশগুল ছিলো, ঠিক সে সময় এইডস রোগে ছ'শ জন মার্কিনী মারা গেছে। সমকামীরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং প্রকৃতিও মানুষকে চরম শাস্তি দিচ্ছে। বর্তমানে লাখ লাখ মানুষ এইডস বা এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে।

মার্কিন এ লেখকের মতে, পশ্চিমা সমাজে গর্ভপাত,তালাক ও আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি সন্তান লাভে তাদের আগ্রহ নেই। মাদকসেবীর সংখ্যাও দিনদিনই বাড়ছে। নারী ও বয়স্কদের সাথে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। এছাড়া অবাধ যৌনাচার বেড়ে গেছে। আর এ সবই প্রমাণ করে পশ্চিমা সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু।
মার্কিন এই লেখক পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবকে হেরোইনের ভয়াবহ প্রভাবের সাথে তুলনা করেছেন। হেরোইন যেমন প্রথমে মানুষকে দৃশ্যত প্রশান্তি দিলেও ক্রমেই মানবদেহকে বিকল করে দিয়ে মাদকসেবীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়, তেমনি পশ্চিমা সভ্যতাও বাহ্যত আকর্ষনীয় হলেও এর চূড়ান্ত ফল বিষময়। আরেক বিখ্যাত মার্কিন লেখক কেনেথ মিনং তার নিউ স্ট্যান্ডার্ড শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন, পশ্চিমা সভ্যতা নীতি-নৈতিকতা থেকে অনেক খানি দূরে সরে গেছে, কাজেই পশ্চিমা সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠতর বলা যাবে না।

যে সমাজের মানুষ নীতি-নৈতিকতা মেনে চলে এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনুরাগী সে সমাজের স্থায়ীত্ব ও গতিময়তাও থাকে বেশী। ইরানের বিখ্যাত লেখক ড: বেলায়াতি তাঁর এক বইয়ে লিখেছেন, কোন সমাজ যদি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় সভ্য হবার পরও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়, তাহলে ওই সভ্যতা ক্রমেই দূর্বল হয়ে পড়ে। চূড়ান্ত পর্যায়ে তা বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতার পথে ধাবিত হয় এবং ওই সমাজের সভ্যতার ভিত্তি ধসে পড়ে। ফলে সভ্যতা তার গতি হারিয়ে ফেলে। কারণ লক্ষ্যহীন সভ্যতার কারণে লাগামহীনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা ছড়িয়ে পড়ে। তবে মুসলিম সভ্যতা সব সময় নীতি-নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা, ঐক্য এবং আইন মেনে চলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
সমাজের অন্য অনেক কিছুর মতো সভ্যতার ক্ষেত্রেও চড়াই-উৎরাই থাকে। কোন কোন বিশেষজ্ঞ মনে করেন,প্রত্যেক সভ্যতাকেই বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়েই সভ্যতা এগিয়ে চলে।

নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে দারুনভাবে সহায়তা করতে পারে। কোন সমাজ সভ্য ও সংস্কৃতিবান হবার পরও যদি ধর্মীয় ও নৈতিক দিককে উপেক্ষা করে তাহলে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ হলো, আন্দালুস বা বর্তমান স্পেনে মুসলমানদের ভয়াবহ পরিণতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামী নীতি-আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা থেকে দূরে সরে যাওয়াসহ আরও কিছু কারণে স্পেনে মুসলমানদের পতন ঘটেছিল। এ কারণেই ইসলাম ধর্ম আধ্যাত্মিকতা ও নীতি-নৈতিকতার উপর সব সময় গুরুত্ব আরোপ করেছে। মুসলিম ইতিহাসে এসেছে, মক্কা থেকে মদীনায় রাসূলের হিজরতের একটা কারণ ছিলো, মক্কার বিরূপ পরিবেশ থেকে দূরে গিয়ে নতুন পরিবেশে নীতি-নৈতিকতা লালন করা ও তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া।

অজ্ঞতা, স্বেচ্ছাচার ও দুর্নীতির কারণেও একটি সভ্যতায় ধস নামে। মার্কিন ইতিহাসবিদ উইল ডোরান্টের মতে, জ্ঞান ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে সভ্যতা দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলিম সমাজ বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুনের দৃষ্টিতেও স্বেচ্ছাচার, স্বৈরাচার ও দূর্নীতি সভ্যতার পতনের কারণ। অন্য যেসব বিষয় সভ্যতার পতন নিশ্চিত করে তাহলো সমাজে অনৈক্য ও হানাহানি ছড়িয়ে পড়া। ইরানের বিশিষ্ট লেখক ও ঐতিহাসিক আব্দুল হোসেন যার্রিনকুব বলেছেন, সভ্যতার টিকে থাকার জন্য ঐক্য ও সংহতি জরুরি। তিনি মনে করেন, অনারবদের উপর আরবদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে উমাইয়ারা যে চুক্তি করেছিল, তা মদীনায় রাসূলের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার উন্নত ভিত্তিকে ক্রমেই নড়বড়ে করে ফেলে। মুসলিম সভ্যতার ভিত্তি সে সময় থেকেই দূর্বল হতে থাকে বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, মুসলিম সভ্যতা দূর্বল হবার পেছনে দূর্নীতি ও বিলাসিতাও একটি বড় কারণ। যার্রিনকুব বলেছেন, তৎকালীন শাম বা বর্তমান সিরিয়ায় বনী উমাইয়াদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই মুসলিম সভ্যতা দূর্বল হতে থাকে।

বিজাতীয় শত্রুদের আক্রমনও সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে দুর্বল করার ক্ষেত্র তৈরী করতে পারে। শত্রুরা অতীতেও বহুবার মুসলিম দেশগুলোতে হামলা চালিয়েছে। এর মধ্যে মোংগলীয় ও ক্রুসেডারদের হামলা অন্যতম। কিন্তু সুখের কথা হলো, মুসলমানরা এসব যুদ্ধে হেরে যায়নি এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তারা তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। সব মিলিয়ে, আমরা যদি মুসলিম দেশগুলোর চড়াই-উৎরাইয়ের ইতিহাস সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখবো, মুসলমানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। স্বয়ং রাসূল (সা.) এ ধারার সূচনা করে গেছেন।

তৃতীয় পর্ব

গত আসরে আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্যতার পতনের নানা কারণ এবং বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতার অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এছাড়া, মুসলিম সভ্যতা নানা প্রতিকূলতার মাঝেও কীভাবে টিকে থাকলো সে বিষয়টিও আমরা তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতা হিউম্যানিজম, লিবারেলিজম ও সেক্যুলারিজম এই তিন মতবাদের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এবং এসব মতবাদে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়না। যাইহোক, আজকের আসরে আমরা মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গঠনে নবী-রাসূলদের ভূমিকা বিশেষকরে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)'র ভূমিকা নিয়ে খানিকটা আলোচনা করবো।

মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি গঠনে নবী-রাসূলরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। নবী-রাসূলগণ যুগে যুগে মানব জাতিকে সৎ পথের দিকে আহ্বানের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লাহতায়ালা সূরা নাহ্‌লের ৩৬ নম্বর আয়াতে সমাজে নবী-রাসূল পাঠানোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, "আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি। তোমরা আল্লাহর উপাসনা করো এবং শয়তানকে বর্জন করো।"
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)'র আগেও আল্লাহতায়ালা পবিত্র মক্কা শহরে কয়েক জন নবী পাঠিয়েছেন। ইব্রাহিম (আ:) তাদের মধ্যে অন্যতম। ইব্রাহিম (আ:)'র আর্বিভাবের পর আরবদের কেউ কেউ একত্ববাদের ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ইব্রাহিম (আ:)'র ইন্তেকালের পর অধিকাংশ আরব এই একত্ববাদী ধর্মের সাথে মূর্তিপূজার কুসংস্কার ও বিশ্বাসের মিশ্রন ঘটায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, ইব্রাহিম (আ:)'র সময় থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্মের আর্বিভাবের আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ আরবই ইব্রাহিম (আ:)'র ধর্মের কিছু রীতি নীতি মেনে চলার পাশাপাশি মূর্তি পুজাও করতো।
তবে আরবদের মধ্যে এমন কিছু মানুষও ছিলেন যারা মূর্তিপুজা করতেন না এবং মানুষকে মূর্তি পুজা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতেন। যারা মূর্তিপুজা না করে ইব্রাহিম (আ:)'র ধর্মের প্রতি অটল ছিলেন,তাদের মধ্যে আব্দুল মোত্তালেব অন্যতম।

বিষয়টি আরো স্পষ্ট করার জন্য আরব ভূখন্ডের ইতিহাস নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক। ঐতিহাসিকরা আরব ইতিহাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করে থাকেন। প্রথমত: জাহিলিয়াতপূর্ব প্রাচীন যুগ, দ্বিতীয়ত: জাহিলিয়াত যুগ এবং জাহিলিয়াত পরবর্তী যুগ। ইসলাম আর্বিভাবের পর জাহিলিয়াত বা অজ্ঞতা যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় ইসলামি যুগ এবং এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো আরবরাও ইসলামপূর্ব যুগে কবিতা ও সাহিত্যের মতো কোন কোন ক্ষেত্রে পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলো। শুধু বিশেষ মহলেই নয় কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি সাধারণ মানুষজনেরও ব্যাপক ঝোঁক ছিলো। বেদুঈন আরবরা নতুন নতুন কবিতা শুনতে কবিদের কাছে আসতেন এবং একসঙ্গে বসে কবিতা আবৃত্তি শুনতেন।

আরবের বাজারগুলোতেই কবি ও শ্রোতাদের বেশি সমাগম ঘটতো। সে সময় যে গোত্রে শক্তিমান ও সৃষ্টিশীল কবির জন্ম হতো সে গোত্রের মানুষ ওই কবিকে নিয়ে গর্ব করতো এবং তার জন্য সম্মানসূচক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। জাহেলি যুগে একজন কবি ইচ্ছে করলেই একজন সাধারণ মানুষকেও প্রশংসার মাধ্যমে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করতে পারতেন এবং একজন সম্মানী ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ করে অথবা তার বিষয়ে দূর্নাম রটিয়ে তাকে অপমান করতে পারতেন। কবির ইশারায় একজন সম্মানী ব্যক্তিও সমাজে তুচ্ছ ব্যক্তিতে পরিণত হতেন। জাহেলি পরিবেশ কবিদের ওপরও প্রভাব ফেলেছিল। সে সময়কার বেশিরভাগ আরব কবিতায় তৎকালীন সমাজের মানুষের জীবনপ্রণালীর চিত্র অংকিত হয়েছে। কবিতাগুলোতে আরব মরুপ্রান্তর, তাবু, তলোয়ার, নানা ধরনের খেলা, মানুষের চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য, নীতি-নৈতিকতা এবং আচার-আচরণ চিত্রায়িত হয়েছে।

ইসলামপূর্ব যুগকে জাহেলি যুগ বলা হয়, কারণ সে সময় সমাজে অজ্ঞতা ও বর্বরতা প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো। আরব উপদ্বীপে কোন আইন-কানুন ও রীতি-নীতি ছিলো না। এছাড়া, আরবে তখন কোন নবী-রাসূলও ছিলেন না যারা আল্লাহর নির্দেশে মানুষকে সৎ পথে পরিচালিত করতে পারেন। কারণ বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)'র আবির্ভাবের আগে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত আরবে কোন নবী-রাসূল আসেননি। এছাড়া, আরব উপদ্বীপের উত্তরের বেশিরভাগ অঞ্চল বিশেষকরে হিজায অঞ্চলটি ছিলো শুষ্ক ও রুক্ষ এবং ইসলামপূর্ব যুগে বেশিরভাগ আরবের বাস ছিলো মরু এলাকায়। মরু অঞ্চলের মানুষজন পানির সন্ধানে একেক সময় একেক দিকে ছুটে যেতেন। এ অবস্থা তাদের মধ্যে বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছিলো। কঠিন ও রুক্ষ পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে অনেকেই তাদের মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো ভুলে গিয়েছিল।

এ কারণে সে সময়ের ইতিহাস যুদ্ধের নানা ঘটনায় ভরপুর। বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীর মধ্যে পশু ও চারণভূমির আধিপত্য নিয়ে যুদ্ধ হতো এবং একে অপরের এলাকায় লুটতরাজ চালাতো। গোত্রপ্রীতি ও কুসংস্কার ছিলো সে সময়ের আরবদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। তারা সামান্য কারণে বড় বড় যুদ্ধের জন্ম দিতো,যা কখনো কখনো বছরের পর বছর ধরে চলতো। জাহেলি যুগের আরবরা নারীদের কোন গুরুত্বই দিতো না। নারীরা মানুষ হিসেবেই গণ্য হতো না। তারা কন্যা সন্তানকে অপমানের বোঝা বলে মনে করতো। কখনো কখনো এই অপমান থেকে রক্ষা পেতে কন্যা শিশুদের জীবন্ত কবর দিতো। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারকে তারা অস্বীকার করতো। এমনকি স্বয়ং নারীদেরকেই উত্তরাধিকার সম্পত্তি ও পণ্য বলে গণ্য করতো।

পবিত্র কোরআনের সূরা নাহলের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে সে সময়কার নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ওদের কাউকে যখন কন্যা-সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখমন্ডল কালো হয়ে যায় এবং ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তাকে যে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে,তার কারণে সে নিজ গোত্র অথবা সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আত্মগোপন করে এবং সে এটা ভাবতে থাকে যে, এই অপমানের পর নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে না কি নিজেকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে? বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন,যখন আরবের মানুষ অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে পুরোপুরি নিমজ্জিত। তিনি এ ধরনের একটি সমাজ থেকে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে কল্যাণের বার্তা পৌছেঁ দেয়ার দায়িত্ব পান। এখানে উল্লেখ্য, সে সময়কার বিশ্ব রাজনীতিতে আরবদের কোন গুরুত্বই ছিলো না, কোন অবস্থানই ছিলোনা। কিন্তু বিশ্বনবী, তাঁর মিশন এবং তার শিক্ষা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আরব ভূখন্ডে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেন।

নবীজীর পথনির্দেশনায় মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতায় এক বিপ্লব সংঘটিত হয়। রাসূল (সা.) নব্যুওয়ত লাভের পর ১৩ বছর মক্কায় ইসলামের মূল নীতি ও শিক্ষা প্রচার করেন। কিন্তু রাসূল(সা.) মক্কায় অবস্থানকালে নানা কারণে ইসলামি রাষ্ট্র ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠার পরিবেশ তৈরী করা সম্ভব হয়নি। হয়তো এর বড় কারণ ছিলো, মক্কার গোত্র ও গোষ্ঠি ভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। গোত্রভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে ব্যাপক বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বনবী (সাঃ) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মক্কার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পদমর্যাদা ও সম্মান কখনোই যোগ্যতা ও সাহসিকতার ভিত্তিতে ছিল না বরং কে কোন গোত্রের ও কোন বংশের তার ভিত্তিতেই ব্যক্তির মর্যাদা নির্ধারিত হতো। এছাড়া, মক্কার ভৌগলিক অবস্থানও বিশ্বে প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উপযোগী ছিলো না। কিন্তু মদিনায় হিজরতের পর রাসূল (সা.) সেই উপযুক্ত পরিবেশ পান।

চতুর্থ পর্ব

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সর্বশেষ ঐশী ধর্ম তথা ইসলাম ধর্ম প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি ১৩ বছর ধরে মক্কা অঞ্চলে ইসলামের বাণী জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু অল্প সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এ ছাড়াও শত্রু দের ব্যাপক বিদ্বেষী আচরণের কারণে তিনি সেখানে অনুকূল পরিবেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের সুযোগ পাননি। ফলে (সাঃ) মক্কা থেকে মদীনায় মুসলমানদের হিজরত বা অভিবাসন শুরু হয়।

মদীনা বা ইয়াসরিব ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য নিরাপদ স্থান। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এ বিষয়টি বুঝতে পেরে মুসলমানদেরকে মদীনায় হিজরত করতে বলেন। নবী হিসেবে দায়িত্ব লাভের ১৪তম বছরের ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার অথবা এর সামান্য কিছু আগে বা পরে রাসূল (সাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন। মক্কা থেকে মদীনার উপকণ্ঠে ক্বুবা নামক স্থানে আসতে তাঁর সময় লেগেছিল নয় দিন। ক্বুবায় তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অবস্থান করেন। এ সময় সেখানে নির্মিত হয়েছিল ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মসজিদ। কয়েকদিন পর মক্কা থেকে মহানবী (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত আলীও রাসূল (সাঃ)''র সাথে মিলিত হন। এরপর তাঁরা একইসাথে মদীনায় প্রবেশ করেন।

ইয়াসরেব বা মদীনা ছিল দুটি বড় ইহুদি গোত্রের সম্মিলন-স্থল। এ ছাড়াও কয়েকটি মোহাজির গোত্র এ অঞ্চলে বসবাস করত। আওস ও খাজরাজ ছিল এসব মোহাজির গোত্রের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোত্র। এসব গোত্রের আবাসস্থল হবার কারণে মদীনার লোকজনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে এক ধরনের নির্লিপ্ত ভাব বা নিস্ক্রিয়তা দেখা যেত। ফলে এখানে নতুন ধর্ম বিকশিত হবার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এ জন্যই মক্কার তুলনায় মদীনা বা ইয়াসরেব শহরে ইসলাম ধর্ম বিকশিত হবার পথ বেশী উন্মোচিত হয়েছিল। এখানকার অ-ইহুদি আরব গোত্রগুলো ইহুদিদের কাছ থেকে আল্লাহ, ওহী বা ঐশী প্রত্যাদেশ, বিচার বা পুনরুত্থান দিবস, বেহশত ও দোযখ প্রভৃতি বিষয়ে ধারণা পেয়েছিল। এ ছাড়াও পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত আওস ও খাজরাজ গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণের মাধ্যমে নতুন মিত্র শক্তির বলে পরস্পরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সূবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। তাই দেখা যায় এ দুটি গোত্র কেবল একে-অপরের আগে নয়, এমনকি ইহুদিদেরও আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য এগিয়ে আসে।

মদীনায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)''র প্রবেশের দিনটি ছিল শুক্রবার। তাঁর ইমামতিতে সেদিনই প্রথম জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জুমার নামাজের খোতবায় মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপনের পর তিনি জনগণকে খোদাভীতি বা তাক্বওয়া অর্জন, সৎ কর্ম ও আল্লাহর পথে জিহাদের আহ্বান জানান। জুমার নামাজ আদায়ের পর তিনি শহরের ভেতরে প্রবেশ করেন। মদীনার জনগণ তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানায়। এ সময় থেকে রাসূল (সাঃ)'র সাহাবায়ে কেরাম মুহাজির ও আনসার হিসেবে পরিচিত হন। যারা মক্কা থেকে হিজরত করে ইয়াসরেবে আসেন তাদের বলা হত মুহাজির। আর মদীনার স্থানীয় সাহাবীদের বলা হত আনসার বা সাহায্যকারী। ইয়াসরেবে মহানবী (সাঃ)'র আগমনের সুবাদে এই শহরের নাম রাখা হয় মদীনাতুননবী বা রাসূলের শহর ।

এভাবে দেখা যায়, ইসলাম ধর্ম মক্কায় যাত্রা শুরু করলেও মদীনা হয়ে পড়ে এ ধর্ম বিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র। মদীনায় জনগণ দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মুসলমানদের সংখ্যা দর্শনীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বনবী (সাঃ) একটি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তিনটি ভিত্তি ছিল। মসজিদ নির্মাণ, মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর।

এভাবে মহানবী (সাঃ) আরবদের মধ্যে শত শত বছর ধরে প্রচলিত জাহেলী যুগের গোত্রীয় বিদ্বেষের অবসান ঘটান। ইসলামী সমাজ বা উম্মাহ গঠনে তাঁর প্রচেষ্টার ফলে ধর্মই মানুষের মধ্যে সম্পর্ক ও বন্ধন বা যোগাযোগের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়। গোত্রীয় বন্ধনের যে ধারা আরবদের মধ্যে জাহেলিয়াত বা কুসংস্কার ও গোত্রীয় নানা কূ-প্রথা সৃষ্টি করেছিল তা ইসলামী সমাজ গঠনের ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এভাবে জাহেলী চিন্তা-চেতনার অবসান ঘটায় মদীনার মুসলমানরা ইসলাম প্রচারের জন্য প্রস্তুত হয়।

বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণের আলোকে বলা যায়, হিজরতের প্রথম দিন থেকেই সভ্যতা গড়ে তোলার লক্ষণগুলো ইসলামে স্পষ্ট হয়ে উঠে। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের মাধ্যমে মুসলমানদের একটি রাজনৈতিক সমাজ বা রাষ্ট্র গড়ে উঠে। এভাবে মহানবী (সাঃ)''র ওয়াদা বাস্তবে রূপ নেয়। মদীনায় মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর ছিল তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি। এই সংবিধানের মাধ্যমে নাগরিকদের সামাজিক অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এমনকি এতে ইহুদিদের নাগরিক ও সামজিক অধিকারকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। এই সংবিধান অনুযায়ী মুসলমানরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা লাভ করে। এভাবে হিজরতের সুবাদে ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে সামাজিক ন্যায়বিচার ও জনমত বা জন সমর্থনের আলোকে একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠে এবং ইসলামী চিন্তাধারা বাস্তবায়নের পথ সূচিত হয়। মক্কায় বিশ্বনবী (সাঃ) ছিলেন একজন সাধারণ নাগরিক, কিন্তু মদীনায় তিনিই হন প্রথম ইসলামী সরকারের প্রধান দায়িত্বশীল।

মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ছিল ভৌগোলিক সীমানা ও অঞ্চল বা ভূখণ্ড, জনগণ, সার্বভৌমত্ব বা স্বাধীনতা ও প্রশাসন। এ ছাড়াও ছিল আইনের শাসন। অন্য কথায় সে রাষ্ট্রে আইনের দৃষ্টিতে ছিল সবাই সমান। কারো ব্যাপারে কোনো বৈষম্য ছিল না। সে যুগে এমন ব্যবস্থা ছিল নজিরবিহীন। তাই তা সব যুগের জন্য আদর্শে পরিণত হয়। দেখা গেছে সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মুসলিম জাহানের খলিফা আমীরুল মুমিনিন হযরত আলী (আঃ) আদালতে তাঁর অধিকার ত্যাগ করেছেন। বিবাদী ইহুদি খলিফার মনোনীত কাজীর এ ধরনের অবিশ্বাস্য রায়ে ও রায়ের প্রতি খলিফার শ্রদ্ধায় বিমুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।

মদীনা সনদ প্রণয়ন ছিল বিশ্বনবী (সাঃ)''র ইসলামী রাষ্ট্রের আরেক মহান কীর্তি। এতে নাগরিকদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও অধিকারের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরই আলোকে সব কিছু ত্যাগ করে কেবল ঈমান নিয়ে আসা মুহাজিরদের নিরাপত্তা বিধান ও সহায়-সম্পদের ক্ষেত্রে আনসারদের সহযোগীতা ছিল অকল্পনীয়। মদীনার স্থানীয় ও বহিরাগত মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করে দেয়া ছিল মহানবী (সাঃ)র এক বড় সাফল্য। এর আগে সম্পর্কের মাপকাঠি ছিল গোত্রীয় পরিচয়। ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের মুমিনদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সীসা ঢালা প্রাচীরের মত দৃঢ় ঐক্য।
পঞ্চম পর্ব

ইসলামের নবী (সা) এর মৌলিক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে একটি ছিল মসজিদ নির্মাণ করা। ইসলামী হুকুমাতের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে মসিজদ প্রতিষ্ঠা করতেন তিনি। আসলে এমন একটি প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনা নির্মাণ করার প্রয়োজন পড়েছিল যা একদিকে হবে মুসলমানদের ইবাদাতের স্থান, অপরদিকে হবে রাজনৈতিক, বিচার, প্রশিক্ষণ এমনকি সামরিক দিকসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র। যাই হোক মসজিদের গুরুত্ব এবং এর ভূমিকা নিয়ে আজকের আসরে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করবো।

প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে মসজিদ ছিল নামায পড়া, জ্ঞানার্জন, বিচারকার্য পরিচালনা এবং হুকুমাতের কেন্দ্র। এছাড়াও মসজিদে বায়তুল মাল, যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের মালামাল ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হতো। এমনকি যুদ্ধবন্দী এবং কারাবন্দীদেরকেও মসজিদে রাখা হতো। অর্থাৎ সামাজিক এবং রাজনৈতিক সকল কার্য পরিচালনার কেন্দ্র ছিল মসজিদ। এদিক থেকে বিচার করলে বলতেই হবে যে মদিনায় নয়া ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে মসজিদের ভূমিকা ছিল মৌলিক এবং অপরিসীম। মসজিদের ভূমিকা এবং কর্মকাণ্ড সম্পের্ক সম্ভবত বলা যায় সে সময় ইমান এবং জ্ঞানের মধ্যকার গভীরতম যে বন্ধনগুলো গড়ে উঠেছিল তা মসজিদ থেকেই গড়ে উঠেছে। ইসলামের হুকুম-আহকাম, ইসলাম পরিচিতিমূলক বক্তব্য মসজিদে দেওয়া হতো, ইসলামী শিক্ষা এমনকি লেখা এবং পড়ার মতো বিষয়গুলোও মসজিদেই শিক্ষা দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে যখন ইসলামী হুকুমাত এবং আদালত বা বিচার বিভাগকে মসজিদ থেকে পৃথক করা হলো তখনো সেগুলো ছিলো মসজিদের প্রতিবেশীসুলভ অর্থাৎ মসজিদ সংলগ্ন রেখেই সেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিলো। সাম্প্রতিক শতাব্দিগুলোতেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শহরের জামে মসজিদের পাশেই গড়ে তোলার প্রচলন ছিলো।

নবী আকরাম (সা) এর অন্যতম মৌলিক একটি দায়িত্ব ছিলো দ্বীনের আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার-প্রসার। সন্দেহাতীতভাবে তার জন্যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক ও বিচার বিভাগীয় কাঠামোর প্রয়োজন ছিলো। এই কাজগুলো বা গুরুদায়িত্বগুলো সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেওয়ার জন্যে নবীজী সুযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলেন। এদের অনেকেই যাকাত এবং সদকা সঞ্চয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন, অনেকেই আবার সামজিক দায়িত্বগুলো পালন করতেন। মদিনার সরকারের প্রশাসনিক বিভাগ ছিল খুবই সাদামাটা তবে সামগ্রিক এবং পূর্ণাঙ্গ। অনেকেই আবার ভিন্ন ভিন্ন আরো কিছু দায়িত্বে নিয়েঅজিত ছিলেন, যেমনঃ চুক্তিপত্র সম্পাদনের কাজ, সম্মতি পত্র লেখালেখি এবং সংরক্ষণের কাজ, আয়কর হিসাব এবং আদায়ের কাজ, যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের হিসাব নিকাশের কাজ এমনকি কেউ কেউ কোরআনের আয়াত লেখালেখির কাজেও নিয়োজিত ছিলেন।

পানির উৎসগুলো এবং ভূমিগুলো যা বিভিন্ন ব্যক্তি এবং গোত্রকে দেওয়া হতো সেগুলোর তালিকা তৈরি করা এবং তাদের জন্যে ভূমির মালিকানা স্বত্ত বা দলিল লেখার দায়িত্বও কারো কারো ওপর দিয়েছিলেন।
আরবদের মাঝে এটা ছিলো একেবারেই নতুন একটি রীতি। কেননা আরবদের মাঝে আবহমান মতানৈক্য ও দ্বন্দ্বের অন্যতম একটি কারণ ছিলো ভূমি, পুকুর এবং জলাশয়ের মালিকানা নিয়ে। নবীজী সেইসব প্রাচীন দ্বন্দ্ব সংঘাত বন্ধের লক্ষ্যে যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন তা ছিলো এক কথায় ঐতিহাসিক এক পদক্ষেপ।
পয়গাম্বর (সা) ইহুদি খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন গোত্রের সাথে চুক্তি বা সন্ধিপত্র করেছিলেন। এইসব চুক্তিপত্রের কথা স্থান কাল পাত্রভেদে এবং মুসলমানদের শক্তিমত্তার অবস্থাভেদে বিভিন্ন রকম ছিলো। কখনো কখনো চুক্তিপত্রের অবস্থা বা পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাবে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন।উদাহরণস্বরূপ হুদাইবিয়ার সন্ধির কথা বলা যায়। হুদাইবিয়ার সন্ধিটি হয়েছিলো মক্কার মুশরিকদের সাথে। ঐ চুক্তিতে মুশরিকদের দেওয়া শর্তগুলো মেনে নেওয়ায় মুসলমানদের অনেকেই অবাক হয়েছিলেন, এমনকি কেউ কেউ বিরক্তও হয়েছিলেন। সে কারণে মুসলমানদের কেউ কেউ ঐ চুক্তির ব্যাপারে আপত্তি পর্যন্ত করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে নবীজীর জীবনকালে কূটনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রজ্ঞার অন্যতম প্রধান ও সফল একটি উদাহরণ ছিলো এই হুদাইবিয়ার সন্ধি। এই চুক্তির ফলে মদিনার নয়া সরকার যেমন দৃঢ়তা ও মজবুতি পেয়েছিলো সেইসাথে নবীজীর লক্ষ্য এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নও সহজতর হয়েছিলো।


রাষ্ট্রীয় এইসব কাজের পাশাপাশি রাসূলে খোদা (সা) বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ, প্রতিবেশী সরকারসহ বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহদেরকে চিঠি লিখেছিলেন। তখনকার দিনে ইরানের বাদশাহ, রোমান সম্রাট, মিশরের সুলতান, ইয়েমেনের শাসক, ইথিওপিয়ার বাদশাসহ আরো অনেক বাদশাকেই চিঠি লিখেছিলেন রাসূলে খোদা (সা)। এইসব চিঠির মূল বিষয় ছিলো পবিত্র দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করা এবং এক আল্লাহর আনুগত্য মেনে নেওয়া তথা তৌহিদের দাওয়াত প্রদান। ইতিহাসবিদ এবং লেখকদের অনেকেরই মতে এইসব চিঠি ছিলো নবীজীর পররাষ্ট্রনীতিরই অংশ। নবীজী এই দাওয়াতকে এবং কূটনীতিকে যুদ্ধ এবং সহিংসতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর সাহাবিরা যদি কাউকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার আগে আটক করতেন তাহলে নবীজী তাদেরকে মুক্ত করে দিতেন।

নবীজীর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিলো ইসলামের পরিধি বিস্তার করা এবং মুসলমানদের সীমান্তে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আরব্য উপদ্বীপের রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরেও বিশ্বব্যাপী ইসলামের দাওয়াত পৌছেঁ গিয়েছিলো। মার্কিন ইতিহাসবিদ বিল ডুরান্ট ইসলামী শাসন ব্যবস্থার সাংগঠনিক কাঠামোয় নবীজীর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী ভূমিকার কথা স্বীকার করে বলেছেন, সই সময় নবীজী কেবল মুসলমানদেরই নেতা ছিলেন না বরং মদীনা শহরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঐ শহরের বিচারকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন।
ইরানের বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক আব্দুল হাসান যাররিন কুব বলেছেনঃ ‘বিশেষ করে মদিনায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশেষত কেবলা পরিবর্তনের পর থেকে রমযান মাসের রোযা পালন, নামায এবং যাকাতে ফেতরার মতো বিধানগুলোর ব্যাপারে কোরআনের আয়াত নাযিল হয়। এইভাবে এই বিধানগুলো বিধিবদ্ধ হয়।'

যাররিন কুবের মতে, ইসলামের আরো কিছু বিধান আরবদের জীবন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলো এবং তাদের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো। এসব বিধানের মধ্যে রয়েছেঃ কেসাস, দিয়া বা রক্তমূল্য, জেহাদ, গনিমত বণ্টন, উত্তরাধিকারের বিধান, মদ হারামের ঘোষণা, হজ্জ্বের বিধান ইত্যাদি। তবে সবকিছুর দায়িত্ব নবীজীর ওপর থাকলেও তিনি তাঁর সাহাবিদের সাথে সবসময় পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করতেন। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর ব্যাপারে তিনি কৌশল নির্ধারণের জন্যে একটি সামরিক পরিষদ গঠন করতেন এবং সবার মতামত চাইতেন। ওহুদের যুদ্ধে তিনি ভিন্ন মত পোষণ করা সত্ত্বেও সাহাবিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকেই গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেব বিভিন্ন দেশ জয় করার মধ্য দিয়ে মুসলমানরা বিভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন। ইসলামের সাথে যেসব সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক ছিল না,সেগুলোকে ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এসবের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ষষ্ঠ পর্ব

পাঠক! গত আসরে আমরা বলেছিলাম পয়গাম্বর (সা) মদিনায় ইসলামী শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় কীভাবে প্রশাসনিক, সামরিক, বিচারিক প্রভৃতি বিভাগ চালু করেছেন এবং ধীরে ধীরে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি কীভাবে বিকাশ লাভ করে। আজকের আসরে আমরা তারই ধারাবাহিকতায় আরো কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।

জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা এমন একটি অনুষঙ্গ যা ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একথা বলাটা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মেই জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে এতো বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। কোরআন এবং হাদিসের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্ববর্গ বা অলি-আওলিয়াগণ কেবল মুসলমানদেরকেই নন বরং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীসহ সকল মানুষকেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জনের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। অন্ধবিশ্বাসী ঈমান অর্থাৎ জ্ঞান-প্রজ্ঞাবিহীন ঈমান আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়। জ্ঞান-বুদ্ধি এমন এক উপাদান যা আমাদেরকে আল্লাহকে চেনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে। আসলে আল্লাহকে চেনার এবং আল্লাহর একত্বকে উপলব্ধি করার গুরুত্বপূর্ণ উপায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা আম্বিয়ার ৬৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো খোদার প্রতি বিশ্বাস রাখা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থেকে দূরে সরে যাবার লক্ষণ বলে ইঙ্গিত করে বলেছেন, "তোমাদের এবং তোমরা আল্লাহ ব্যতিত যাদের উপাসনা করো তাদের ওপর ধিক্কার! আচ্ছা,তোমরা কি চিন্তা করো না! ( অর্থাৎ তোমাদের কি জ্ঞান-বুদ্ধি নেই?)"

ইসলাম মূর্খ লোকদেরকে ভৎর্সনা করে। মূর্খতা মানে কেবল অশিক্ষা নয়। আমরা এমন অনেক জ্ঞানী-গুণী লোককেও দেখতে পাই যারা সত্যের ব্যাপারে অন্ধ এবং অজ্ঞ। তারা আসলে শিক্ষিত বটে কিন্তু এ অর্থে যে,তারা বাইরের জগত সম্পর্কেই বেশি জানে,তাদের স্মৃতিটা জ্ঞাত বিষয়সমূহের একটি ভাণ্ডার ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবনের মৌলিক বিষয়-আশয় সম্পর্কে তারা চিন্তা-ভাবনা করে না বলে সঠিক পথের সন্ধান পায় না। মানবেতিহাস পরিক্রমায় দেখা গেছে দ্বীন এবং জ্ঞানকে যারা সাংঘর্ষিক দৃষ্টিতে দেখেছেন পরবর্তীকালে ইসলামে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সু-উচ্চ অবস্থান দেখে তারা হতবাক হয়ে গেছেন। ঐশী এই ধর্মের ইতিহাসে তো নয়ই এমনকি ইসলামী চিন্তা-চেতনা বা কর্মতৎপরতায়ও জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার মাঝে কোনোরকম দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয় না। জাবের ইবনে হাইয়্যান, মুহাম্মাদ্ইবনে মূসা খাওয়ারেযমি, মুহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া রাযি, ফারাবি, ইবনে হিশাম, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ প্রমুখের মতো আরো বহু মুসলিম মনীষীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভই প্রমাণ করে যে ইসলাম জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার মাঝে গভীর সমন্বয়ের পক্ষপাতী।

ইসলামে সবসময়ই জ্ঞান-প্রজ্ঞা এবং আধ্যাত্মিকতার সমন্বিত কল্যাণের প্রতি মনযোগ আকর্ষণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সর্বপ্রথম যে সূরাটি নাযিল হয়েছে তার প্রাথমিক আয়াতগুলোতেও জ্ঞানার্জনের প্রতি ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছেঃ "পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে। পড়ো সেই প্রভুর নামে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও মহাদয়ালু। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন সেইসব-যা সে জানতো না। "

কোরআনের সর্বপ্রথম এই আয়াতগুলো নাযিল হবার সময়কালের প্রতি একটু মনোযোগী হলে আয়াতগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করা যাবে। যখন এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় সে সময় মক্কা এবং হেজাজে লিখতে পড়তে জানা লোকের সংখ্যা একর্থে ছিল না বললেই চলে। যৎসামান্য পড়তে জানা বা লিখতে জানা লোকের সংখ্যা সমগ্র মক্কায় ছিলো বিশ জনেরও কম। অথচ সে সময় মক্কা ছিলো হেজাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং ইবাদাত-উপাসনার মূল কেন্দ্র। এরকম পরিস্থিতিতে পড়ালেখার ব্যাপারে প্রত্যয় ঘোষণা করা থেকে উপলব্ধি করা যায় যে ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞানার্জন এবং প্রজ্ঞা লাভের কতো বেশি গুরুত্ব রয়েছে।

তদুপরি রাসূলে খোদা (সা) জ্ঞানার্জনকে সবার জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। মদিনায় তিনি চেষ্টা করেছেন জ্ঞান বা শিক্ষা বিস্তারের সুযোগ সুবিধাগুলোকে সবার জন্যে সমানভাবে উন্মুক্ত করে দিতে। যাতে সর্বশ্রেণীর মানুষই আল্লাহ প্রদত্ত মেধার বিকাশ ঘটিয়ে নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী জ্ঞানী হয়ে উঠতে পারে। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় লাভের পর মুশরিকদের একটি দলকে বন্দী করে নিয়ে আসা হয়। বন্দীদের মাঝে কতিপয় শিক্ষিতও ছিলেন। নবীজী ঘোষণা করেছিলেন বন্দীগণ দশজন মুসলমানকে পড়ালেখা শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি পেতে পারে। নবীজীর এই পদক্ষেপের ফলে বহু মুসলমান পড়ালেখা শেখার সুযোগ পায়। যায়েদ ইবনে সাবেত ছিলেন বন্দীদের মাধ্যমে শিক্ষা লাভকারীদের একজন। এভাবে তৎকালীন সমাজে জ্ঞানার্জনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবও পড়েছিলো।

ইতিহাসের দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যাবে, ইসলামী সভ্যতার যুগে মুসলিম বিশ্বে বিচিত্র জ্ঞানের প্রসার লাভ ঘটেছিলো। মুসলমানরা কেবল ইসলামী জ্ঞান বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানই নয় বরং সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখারও গোড়াপত্তন করেন অর্থাৎ জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় মুসলমানদের মাধ্যমেই সৃষ্ট এবং বিকশিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব বিষয়ে পাঠ দান করা হতো। ধর্মীয় এবং জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্রগুলোতে বড়ো বড়ো গ্রন্থাগারও স্থাপিত হয়েছিলো। জ্ঞানের চর্চা এবং ধর্মীয় শিক্ষা-দীক্ষা তখন সমন্বিতভাবে অগ্রসর হয়েছিলো। অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তজা মোতাহহারি (রহ) জ্ঞান এবং বিশ্বাস সংক্রান্ত বিতর্কে খ্রিষ্টিয় দৃষ্টিভঙ্গির ভ্রান্তির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, খ্রিষ্টিয় এই ভুল চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ইউরোপীয় সভ্যতার ইতিহাসে ঈমান এবং জ্ঞান আলাদা হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞান এবং বিশ্বাস সবসময় পরস্পরের পরিপূরক ছিলো-চাই বিকাশের সময়ই হোক কিংবা অবক্ষয়ের যুগে। তাঁর মতে জ্ঞান এবং ঈমান সমন্বিতভাবে মানুষকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে কোরআনের বিভিন্ন স্থানে জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আয়াত নাযিল হয়েছে। কোরআনে বিভিন্ন প্রসঙ্গে জ্ঞান শব্দটি অন্তত আশি বার এসেছে।

জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো আজকের আলোচনা। একদিন রাসূলের সাহাবিদেরই একজন নবীজীর কাছে জানতে চাইলেনঃ হে রাসূলে খোদা! মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন অনুষ্ঠান আর জ্ঞানীর আসর-এ দুয়ের মধ্যে কোন্‌টি আপনার কাছে বেশি প্রিয়? নবীজী জবাবে বললেনঃ লাশ দাফন করার জন্যে যদি কেউ থাকে তাহলে একজন আলেমের মজলিসে উপস্থিত হওয়াটা এক হাজার লাশ দাফন, হাজার রোগী দেখতে যাওয়া, হাজার রাত্রি ইবাদাত করা, হাজার দিন রোযা রাখা, ফকির মিসকিনদেরকে হাজার দিরহাম সদকা দেওয়া, হাজার বার হজ্জ্ব করা এবং হাজার বার জান্এবং মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার চেয়ে উত্তম। তোমরা কি জানো না কেবল জ্ঞানের মাধ্যমেই আল্লাহর ইবাদাত বা আনুগত্য করা যায়? দুনিয়া এবং আখেরাতের কল্যাণ নিহিত রয়েছে জ্ঞানের মধ্যে আর দুনিয়া এবং আখেরাতের অমঙ্গল নিহিত রয়েছে মূর্খতার মধ্যে।
৭ম পর্ব

মুসলিম সভ্যতা বিকাশের প্রসঙ্গ এলেই ভাষা লিপিবদ্ধ করার ইতিহাস এবং লেখ্য রূপের সাথে মুসলমানদের পরিচিত হওয়ার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। কাগজ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে কোন কিছু লিখে রাখার বিষয়টি অনেক সহজসাধ্য হয়। কোন কোন প্রাচ্যবিদের মতে, কাগজ আবিস্কৃত না হলে মুসলমানদের প্রাথমিক যুগের সংস্কৃতি এত বেশি বিস্তার ও সমৃদ্ধি লাভ করতে পারতো না। আজকের পর্বে আমরা ভাষার লেখ্য রূপের বিস্তার এবং ইসলামি সভ্যতায় এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করবো।

ইসলাম আবির্ভাবের পর এই ধর্মের সুস্পষ্ট বার্তা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে। ভাষার লেখ্য রূপ এই বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আরবি ভাষার লেখ্য রূপের ইতিহাসের একটা বড় অংশই পবিত্র কোরানের সাথে সম্পর্কিত। মুসলমানদের সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় রাখার ক্ষেত্রেও ভাষার লেখ্য রূপ এবং লেখার ধরণ অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে মুসলমানরা যে দেশ, জাতি ও ভাষারই হোক না কেন, ঐশী গ্রন্থ কোরআনকে অভিন্ন ভাষা ও স্টাইলে তেলাওয়াত করে থাকে। মুসলমানদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ়, এটি তারই প্রমাণ।

ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, জাহেলি যুগে খুব অল্প সংখ্যক আরব, ভাষার লেখ্য রূপ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কারণ সে সময় আরব অঞ্চলের মানুষের জীবন-ব্যবস্থাই এমন ছিলো যে, তারা কোন কিছু লিখে রাখার প্রয়োজনবোধ করতো না। ওই সময় আরব সমাজে মূলত ভাষার শ্রুতি রূপটিই চালু ছিলো। বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীগুলোর গর্ব করার মতো বিষয়গুলো তা কবিতাই হোক আর গল্পই হোক,তা মৌখিক পরম্পরায় উত্তরসূরিদের কাছে পৌঁছে যেতো। তবে পুরনো যে সব কবিতা পাথরে খোদাই করা অবস্থায় ছিলো, সেসব থেকে লেখ্য রূপ ও লেখার সরঞ্জামগুলোর ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বলা হয়, অতীতে ওই এলাকায় যে লিপি চালু ছিলো, তা ছিলো অনেকটাই নাবাতি লিপির মতো। মুসলিম গবেষক ও গ্রন্থ বিশেষজ্ঞ ইবনে নাদিম তার ‘আল ফেহরেস্ত' গ্রন্থে মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর দাদা আব্দুল মোত্তালিবের হস্তলিপির কথা উল্লেখ করেছেন। আব্বাসীয় খলিফা মামুনের কোষাগারে ওই লিপি সংরক্ষণ করা হতো।

ইসলাম আবির্ভাবের পরপরই কেরানের যে ক্ষুদ্র অংশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, তা থেকেও প্রমাণিত হয়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে লেখ্য রূপ বা লিপির সাথে আরবদের প্রাথমিক একটা পরিচিতি ছিলো। পবিত্র কোরানে মুসলমানদেরকে লেনদেনের বিষয়টি লিখে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা সূরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ""হে বিশ্বাসিগণ, যখন একে অন্যের সাথে কোন নির্দিষ্টকালের জন্য ধারের আদান-প্রদান করবে, তখন তা লিখে রাখো এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক যেন তা ন্যায়ভাবে লিখে দেয়"।"
ওই আয়াত অনুযায়ী, মুসলমানদের দায়িত্ব হলো, আর্থ-বাণিজ্যিক সম্পর্ককে লিখিত ও দালিলিক রূপ দেয়া। রাসূলের হাদিসে বিভিন্ন বিষয় লিখে রাখতে বলা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমার জ্ঞান ও শিক্ষা লিপিবদ্ধ করো। রাসূল (সা.)'র কয়েক জন বিশেষ কাতেব বা লিপিকার ছিলেন, যারা কোরানের আয়াত লিখে রাখতেন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চুক্তি ও চিঠিপত্র লিখতেন। পবিত্র কোরানের ওহী যারা লিখে রাখতেন,তাদের মধ্যে হযরত আলী (আ.)''র ছিলেন অন্যতম।

আরবে যেহেতু চামড়ার দাম ছিলো চড়া, সে কারণে কাতেব বা লিপিকাররা তা নিয়মিত ও ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করতে পারতো না। ইতিহাসেও এসেছে, আব্দুল মোত্তালেবও সে সময় চামড়ায় লিখতেন। চামড়ার স্থায়ীত্ব যেহেতু বেশি, সে কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি লিখে রাখার ক্ষেত্রে তা ব্যবহৃত হতো। চামড়ায় লেখার গুরুত্ব, বনী আব্বাসীয়দের শাসনামলের মাঝ সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। বিভিন্ন চুক্তি, গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ ও চিঠিপত্র চামড়ায় লিখা হতো। রাসূলের সহধর্মিনী উম্মে সালমা বলেছেন, রাসূল (সা.) আমার কাছে চামড়া চেয়ে নিলেন । সে সময় আলী(আ:)ও সেখানে ছিলেন। রাসূল বলছিলেন আর আলী (আ.) লিখছিলেন। আলী (আ.) এমন ভাবে লিখলেন যে, চামড়ার দুই পাশ এবং কিনারাগুলোও পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। আরবরা অন্যান্য জিনিস যেমন গৃহপালিত বিভিন্ন পশু যেমন উট ও ভেড়ার হাড়, খেজুড় গাছের শুষ্ক বাকল, এমনকি খেজুড়ের শুষ্ক পাতা এবং কাপড়, লেখার জন্য ব্যবহার করতো।

হিজরী প্রথম শতাব্দির প্রথমার্ধের বিভিন্ন ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সে সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান হতো। সে সময়কার চিঠির মধ্যে আলী (আ.)''র চিঠি-সমগ্র অন্যতম। বিখ্যাত নাহজুল বালাগার একটি অংশে আলী (আ.)''র চিঠি স্থান পেয়েছে। আশেপাশের সভ্যতাগুলোর সাথে মুসলমানদের পরিচিতিও লেখার উপকরণকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে কিছুটা ভূমিকা রেখেছে। মিশর ও সিরিয়া জয় করার পর মুসলমানরা প্যাপিরাসের সাথে পরিচিত হয় এবং এর পরই প্যাপিরাসে লেখা শুরু করে। উমাইয়াদের খেলাফতের পুরো সময়টায় এবং আব্বাসীয়দের খেলাফতের প্রথম দিকে ইরাক,মিশর ও সিরিয়ায় প্যাপিরাসে খেলার প্রচলন ছিলো। ইতিহাসে এসেছে, আব্বাসীয় খলিফা মনসুর তার এক প্রতিনিধিকে কোষাগারে মজুদকৃত প্যাপিরাস বিক্রি করে দেয়ার নির্দেশ দেন যাতে এর ফলে কোষাগারের স্থান সংকটের সমাধান হয় এবং সরকারি বাজেটে কিছু অর্থ যোগ হয়। কিন্তু এর অল্প সময় পরই তিনি ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং প্রয়োজনের কারণে এর বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দেন।
হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দির প্রথমার্ধের শেষ দিকে কাগজ, প্যাপিরাস ও চামড়ার স্থান দখল করে নেয়। কাগজ তৈরী এবং কাগজ শিল্পের বিস্তারে মুসলমানদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাসে এসেছে, হিজরী প্রায় ১৩৪ সনের দিকে বর্তমান উজবেকিস্তানের উত্তরে মুসলিম সেনা কমান্ডার যিয়াদ বিন সালেহ'র নেতৃত্বে তুর্কি ও চীনা আমিরদের সাথে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে যিয়াদ বিন সালেহ, চীন দেশীয় কয়েকজনকে বন্দি করেন। এসব বন্দী কাগজ তৈরির কৌশল সম্পর্কে জানতেন। তাদেরকে তিনি সমরখন্দে নিয়ে যান। ওই সব বন্দীদের মাধ্যমে কাগজ শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করে এবং অন্যান্য মুসলিম এলাকাতেও তা ছড়িয়ে পড়ে। মান সম্পন্ন ও সস্তা হবার কারণে সমরখন্দের কাগজের সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

এরপর মুসলমানরা ওই সব চীনা বন্দির কাছ থেকে কাগজ তৈরির কৌশল শিখে নেয় এবং এই শিল্পকে আরো সমৃদ্ধ করে। মুসলমানরা পরবর্তীতে তুলা এবং অন্যান্য উদ্ভিদ থেকে কাগজ তৈরি করতে সক্ষম হয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে কয়েক ধরনের কাগজ বাজারে আসে। আল ফেহরেস্ত গ্রন্থে গবেষক ইবনে নাদিম কয়েক ধরনের কাগজের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন। এসব কাগজ আবার বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পরিচিতি লাভ করেছিল।
এভাবে আস্তে আস্তে কাগজ শিল্প ইরাক, মিশর, সিরিয়া, মরক্কো, বর্তমান স্পেন ও ইরানের মতো মুসলিম ভূখন্ডগুলোতে বিস্তার লাভ করে এবং ঐসব এলাকাতেও কাগজ তৈরি হতে থাকে। খলিফা হারুনুর রশিদের ইরানি বংশোদ্ভুত মন্ত্রী ফজল বিন ইয়াহিয়া বারমেকি বাগদাদে কাগজ শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন। বাগদাদের কয়েক কেন্দ্রে কাগজ তৈরি হতো। এরপর আস্তে আস্তে বাগদাদের কাগজের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং সবচেয়ে ভালো কাগজ হিসেবে সমাদৃত হতে থাকে।
ঐতিহাসিকরা বলেছেন, বাগদাদের কাগজ এতটাই মানসম্পন্ন ছিলো যে, তা পবিত্র কোরআন লেখার কাজেও ব্যবহার হতো। হিজরী পঞ্চম শতাব্দিতে কাগজ শিল্প ইরাক থেকে সিরিয়ায় যায় এবং ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। দামেস্ক তথা সিরিয়ায় তৈরি কাগজও পরবর্তীতে সুনাম অর্জন করে এবং সিরিয়ার তৈরি কাগজ, পূর্ব ইউরোপে রপ্তানি করা হতো। মিশরে তুলনামূলক বিলম্বে কাগজ শিল্পের বিকাশ ঘটলেও সেখানকার কাগজও মানসম্পন্ন ছিলো বলে ঐতিহাসিক সনদে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মুসলিম বিশ্বের পশ্চিমে অর্থাৎ উত্তর আফিকা, স্পেন ও সিলিলিতেও কাগজের মিল ছিলো এবং সেখান থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোতে কাগজ রপ্তানি করা হতো। ইতিহাসে পাওয়া যায়, হিজরী সপ্তম শতকে ইরানে কাগজ তৈরি হতো।

এভাবেই মুসলমানরা লেখালেখি এবং সংস্কৃতি বিনিময়ের অন্যতম প্রধান উপাদান কাগজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এবং এর উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মিশর ও স্পেনের মাধ্যমে এই শিল্প ইউরোপে প্রবেশ করে এবং ১২৭৬ খ্রীষ্টাব্দে ইতালিতে, ১৩৪৮ সালে ফ্রান্সে, ১৩৯০ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানিতে ও ১৪৯৫ সালে বৃটেনে কাগজ মিল প্রতিষ্ঠিত হয়।

৮ম পর্ব

ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রচলিত ভাষার শ্রুতি ও লেখ্য রূপ নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, মুসলমানরা কোরানের আয়াত লিখে রাখতে এবং নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তা-চেতনা অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে ভাষার লেখ্য রূপকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে ও একই লক্ষ্যে কাগজ শিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করে। আর কাগজ শিল্প তৎকালীন মুসলিম ভূখন্ড স্পেন ও মিশরের মাধ্যমে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউরোপে প্রথম কাগজ মিল প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং বিজ্ঞানীদের গুরুত্ব নিয়েই আজকের আসরে আমরা আলোচনা করা হবে।

এ কথা সবাই জানে যে, বিশ্ব সভ্যতার বিকাশে মুসলমানদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। পাশাপাশি মুসলিম সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করতে অন্যান্য সভ্যতার ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে গ্রীক, ভারতীয় ও পারস্য সভ্যতার কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। যেমন দর্শন ও যুক্তিবিদ্যাকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গ্রীক সভ্যতার ভূমিকা রয়েছে। মুসলমানরা সাধারণত প্রাচীন সিরিয়ো ও ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত বই-পুস্তকের মাধ্যমে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়েছেন। আর গ্রিক ভাষা থেকে বিভিন্ন বই অনুবাদের কাজটি করতেন ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কয়েক জন খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। এদের কেউ কেউ অবশ্য পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কেউ কেউ আবার বই অনুবাদ করতেন মুসলিম খলিফাদের কাছ থেকে আর্থিক পুরস্কারের আশায়। গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটা অংশ আলেকজান্দ্রিয়া শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে পৌঁছেছে।

মুসলমানরা গণিত, জ্যোতিষ শাস্ত্র, চিকিৎসা ও প্রকৃতি বিজ্ঞানকে বিকশিত করার ক্ষেত্রেও গ্রিক বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েছে। তারা টলেমীয় গণিতের সাথে পরিচিত হয় এবং জ্যোতিষ শাস্ত্রের সংস্পর্শে আসে। এছাড়াও টলেমিয় জিওগ্রাফির সহযোগিতায় মুসলমানরা ভৌগলিক ম্যাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়। মুসলমানরা গ্রিক চিকিৎসাশাস্ত্র থেকেও উপকৃত হয়েছে। বিশেষকরে গ্রিক মনিষী গ্যালেনাস ও হিপোক্রেটিসের বইগুলো থেকে মুসলমানরা অনেক তথ্য নিয়েছেন। জাবের ইবনে হাইয়ানের বইয়ে ওই সব মনীষীর বিভিন্ন গ্রন্থ ও লেখা থেকে উপকৃত হবার কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে মুসলমানরা ভিন্ন ভাষা থেকে অনুদিত বইয়ের চেয়ে গ্রিক চিকিৎসা শাস্ত্রবিদদের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে এই শাস্ত্রের সঙ্গে বেশি পরিচিত হয়েছেন।

দামেস্ক মুসলিম খেলাফতের রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত হবার পর গ্রিক বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মুসলমানদের যোগাযোগ সহজ হয়। বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ ফুয়াদ সাজগিন এ বিষয়ে লিখেছেন, মুয়াবিয়াকে বিষ সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ দেয়ার জন্য তার প্রাসাদে ‘অসল' নামের একজন চিকিৎসক ছিলেন। এছাড়াও আবুল হাকাম নামের আরো একজন খ্রিষ্টান চিকিৎসকও মুয়াবিয়ার প্রাসাদে চিকিৎসা কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ ফুয়াদ সাজগিনের গবেষণা অনুযায়ী, তৃতীয় হিজরীর প্রথমার্ধে গ্রিস থেকে মুসলিম বিশ্বে চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান ও তথ্যের সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়।

ইতালীয় প্রাচ্যবিদ আলদুমিয়েলি লিখেছেন, মুসলিম সভ্যতায় ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাবও বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। ১৫৪ হিজরিতে কয়েকজন ভারতীয় বিজ্ঞানী আব্বাসিয় খলিফা মনসুরের কাছে আসেন। এর মধ্যে বিশিষ্ট জ্যোতিষবিদ মন্কাও ছিলেন। তিনি ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান বিশেষকরে ভারতীয় জ্যোতির্বিদ ব্রক্ষ্মগুপ্তের এস্ট্রনমিক্যাল চার্ট বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। খলিফা মনসুর ওই জ্যোতিশাস্ত্রবিদকে তার দরবারের কিছু লোকজনকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার আহ্বান জানায়। এরপর ব্রক্ষ্মগুপ্তের গ্রন্থটিকেও আরবি ভাষায় অনুবাদ করার নির্দেশ দেন। মংকার দেয়া শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে ভারতীয় জ্যোতিবিজ্ঞান চর্চা খলিফা মামুনের শাসনামল পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। সে সময় মুসলিম জ্যোতির্বিদ ইব্রাহিম ফারাযিকে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখার এবং নক্ষত্র কেন্ত্রিক বর্ষ গণনা সংক্রান্ত বই লেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আবু রায়হান বিরুনি তার লেখা বইয়ে বহু বার ফারাযির বইকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানও ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্র থেকে উপকৃত হয়েছে। ইবনে নাদিম তার আল-ফেহরেস্ত গ্রন্থে চিকিৎসা বিষয়ক ১২ টি ভারতীয় বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। এসব বই আব্বাসিয়দের শাসনামলের প্রথম দিকে অনুদিত হয়েছে। মুসলমানরা ভেষজ, খনিজ ও প্রাণিজ ওষুধের সঙ্গে পরিচিত হতে অনেক ক্ষেত্রেই ভারতীয় চিকিৎসাবিদদের লেখা বই পড়তেন।

এবার ইরান তথা পারস্য সভ্যতা প্রসঙ্গে আসছি। ইসলামপূর্ব যুগে ইরানের খসরু আনুশিরাভানের সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালানো হয়। বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে এই সাফল্যের কেন্দ্রস্থল ছিল তৎকালীন ইরানের জুন্দি শাপুর শহর। এই শহররিট বর্তমান ইরানের শুশতার ও দেযফুল শহরের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত ছিল। সে সময় ওই শহরে কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তখন সিরিয়ো খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী বিজ্ঞানী ও অধ্যাপকদের এসব স্কুলে আমন্ত্রণ জানানো হতো। ওই সময় এক দল বিজ্ঞানীর সহযোগিতায় গ্রিক, সিরিয়ো ও সাংস্কৃত ভাষা থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক বইগুলো পাহলভি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। জুন্দি শাপুরের অনুবাদকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে কাজ করেছেন। জুন্দি শাপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্ভবত চতুর্থ খ্রিষ্টাব্দের দিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওরফা থেকে বিতাড়িত হবার পর কনস্টানিনোপলের বিজ্ঞানীরা জুন্দিশাপুরে বসতি গড়েন এবং তারা গ্রিক ভাষা থেকে প্রাচীন সিরিয়ো ভাষায় অনুদিত বিভিন্ন বই সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসেন। এছাড়া, গ্রীসের অনেক নির্বাসিত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বও এখানে এসে দর্শন শাস্ত্র পড়াতে থাকেন এবং এদের অনেকেই পরে এরিস্টটল ও প্লেটোর বই পাহলাভি ভাষায় অনুবাদ করেন।

এর পরের ইতিহাস হলো, ইরানিরা ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইরান ইসলামি ভূখন্ডের অংশে পরিণত হয়। অনেক ইরানি বই ও প্রবন্ধ ফার্সি থেকে আরবিতে অনুদিত হয়। আব্বাসিয় শাসনামলের পরে পাহলাভি থেকে আরবিতে যেসব বই ও প্রবন্ধ অনুবাদ করা হয়েছিল,তার বেশির ভাগই ছিলো, সাহিত্য ও ইতিহাস সম্পর্কে। আব্বাসিয়দের আমলে পাহলাভি ভাষা থেকে আরবিতে অনুবাদের নবযুগ শুরু হয়। এসব বই আব্বাসিয় খলিফার দরবারের প্রভাবশালী ইরানিদের সহযোগিতায় অনুদিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বারমেকি পরিবারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই পরিবার ইরানি মনিষীদের বাগদাদে নিয়ে যাওয়া এবং ইরানি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই অনুবাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ওই সময় জ্যোতি শাস্ত্র বিষয়ক তথ্যাবলীই বেশি বেশি ইরান থেকে মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। বড় বড় চিকিৎসাবিদকে সে সময় ইরানের জুন্দিশাপুর থেকে বাগদাদে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিশিষ্ট মুসলিম গবেষক ও বই বিশারদ ইবনে নাদিম লিখেছেন, বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ নুবাখত ও তার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ বই পাহলাভি থেকে আরবিতে অনুবাদ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন।

৯ম পর্ব

আজ আমরা অনুবাদ আন্দোলন বা যুগের দিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করবো। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির গঠন ও বিকাশে এই অনুবাদ যুগের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। কীভাবে অনুবাদের ধারা ইসলামী সভ্যতার গঠনে অবদান রেখেছে তা নিশ্চয়ই একটা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার।

ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানগণ ইসলামের নয়া হুকুমাতকে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার স্বার্থে এবং শত্রুদের ওপর বিজয় সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যেই মনোনিবেশ করেছিল বেশি। তবে এক্ষেত্রে মুসলমানদের দৃষ্টি ছিল কোরআনের আদেশ-নির্দেশ এবং শিক্ষাগুলোর দিকে। এছাড়াও ব্যাকরণ, বিজয়ের ইতিহাস, ফিকাহ বা ইসলামী নীতিমালা এবং এ জাতীয় অপরাপর জ্ঞান-বিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোর প্রতি মুসলমানদের সচেতন দৃষ্টি ছিল। ধীরে ধীরে বিজয়ের ঘনঘটা স্তিমিত হয়ে এলো আর ইসলামী শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থিতিশীল হলো। মুসলমানরা তাই ইসলামী শিক্ষাগুলো বিস্তারের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে ভালোই সুযোগ পেলো। আব্বাসীয় খলিফাদের কারো কারো অনুপ্রেরণামূলক নীতি এবং বায়তুল মালের অঢেল সম্পদের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা এবার আস্তে আস্তে শিল্প-কলকারখানা ও বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকতে থাকে, ইতোপূর্বে যা ছিল অমুসলিমদের হাতে। যাই শিল্প ও জ্ঞানের দিকে মনোনিবেশ করার ফলে মুসলমানদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটতে শুরু করে।

ইসলামের ঐশী জ্ঞান তথা কোরআনের জ্ঞানের বরকতে যারা চিন্তা-চেতনার উঁচুমার্গে পৌঁছেছেন, তারা বিভিন্ন জাতির ঐতিহ্য, সভ্যতা, কৃষ্টি-কালচার, চিন্তাধারা ইত্যাদি বিষয়ে জানার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন মনে করেন মুসলমানদের এই আগ্রহের মূল উৎস হচ্ছে কোরআনের সেইসব আয়াত এবং সেইসব হাদিস যেগুলোতে মানুষকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে, অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। তো অন্যান্য দেশ ও জাতির সভ্যতা ও জ্ঞান সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করার স্বার্থেই অনুবাদের আশ্রয় নেওয়া হয়। অনুবাদের মাধ্যমে অপরাপর জাতির জ্ঞান ও শিল্পকর্মগুলোকে অর্জন করার এই পদক্ষেপ সেই সময়ের জন্যে অসম্ভব দূরদর্শী এবং চিন্তা-চেতনাগত উৎকর্ষের পরিচায়ক ছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান পিপাসু এবং জ্ঞানীগুণী মনীষীগণ এই অনুবাদকর্মে এতো বেশি উৎসাহী ও কর্মতৎপর হয়ে উঠেছিলেন যে পরবর্তীকালে ঐ সময়টাকে ইতিহাসে ‘অনুবাদের যুগ' বলে অভিহিত করা হয়েছে।

অনুবাদ যুগের উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের একটি উদাহরণ হলো ফেহরেস্‌ত বা নির্ঘণ্ট। এটি লিখেছিলেন ইবনে নাদিম। এই গ্রন্থটি পূর্ববর্তীদের জ্ঞানচর্চার ছোট্ট একটি নমুনামাত্র। হিজরী চতুর্থ শতাব্দি পর্যন্ত সময়কালের মুসলিম বিশ্বে জ্ঞান চর্চার যে ধারা বহমান ছিল তারই ক্ষুদ্র একটি উদাহরণ লক্ষ্য করা যাবে এই গ্রন্থ-দর্পণে। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ ও জাতির সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে খুব কম গ্রন্থই লেখা হয়েছে যে গ্রন্থে এই নির্ঘণ্টের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়নি। ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ আরো কয়েকটি উৎস হলো আখবারুল উলামা এবং তাবাকাতুল আতবা গ্রন্থ দু'টি। ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস এবং এই সভ্যতা বিকাশের কারণ নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারা এই গ্রন্থ দু'টি থেকে বহু উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। উমাইয়া শাসনামলে গ্রিক এবং সুরিয়ানী ভাষার বহু মূল্যবান গ্রন্থও আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। চিকিৎসা বিষয়ক এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে কোন্নাশ। উমাইয়া শাসক প্রথম মারওয়ানের সময় এটি অনূদিত হয়েছিল। তবে উমাইয়া শাসনামলে অনূদিত কর্মের বেশিরভাগই ছিল প্রশাসনিক, বিচারিক, রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক দলিল-দস্তাবেজ। এগুলো অনারবদের সাথে বিভিন্ন রকম যোগাযোগ বা সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল।

আসলে অনুবাদ আন্দোলন বলতে যা বোঝায়, বিশেষ করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন গ্রন্থ ব্যাপক পরিমাণে অনুবাদ হবার কাজটি শুরু হয় আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনামল থেকে। জ্ঞানের এই আন্দোলন তথা অনুবাদের এই ধারা অন্তত দুই শ' বছর অব্যাহত ছিল। আব্বাসীয় শাসকদের মধ্য থেকে দ্বিতীয় খলিফা মানসুর ভিন্ন দেশ, বিদেশী সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক বই পুস্তক অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি অবদান রেখেছেন। তাঁর শাসনামলে অনুবাদকর্ম ব্যাপক উৎকর্ষ লাভ করেছিল। বহু ইতিহাসবিদ মানসুরকে অনুবাদকর্ম বা অনুবাদের ধারার স্থপতি বলে মনে করেন এবং তাদের মতে এই ধারা বিকাশে খলিফা মানসুরের ভূমিকাই ছিল সবার আগে উল্লেখ করার মতো। মানসুর দাভানিকি বাগদাদকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। তিনি জ্যাতির্বিজ্ঞানীদেরকে তাঁর দরবারে নিয়ে এসেছিলেন এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য শাসকও তাঁর ঐ কাজকে অনুসরণ করেছিল। খলিফা মানসুর জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সাথে পরামর্শ না করে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে সাধারণত হাত দিতেন না।

সেই যুগে জ্যোতির্বিজ্ঞানে ইরানী মনীষীদের জ্ঞান এতো বেশি ছিল যে, খলিফা মানসুর একদল ইরানী জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অবশ্য জযেোতির্বিজ্ঞানে মুসলমানদের আগ্রহ জাগার পেছনে আগ্রহ বা প্রেরণা জুগিয়েছিল আলকোরআন। কেননা কোরআন মুসলমানদেরকে আল্লাহর সৃষ্টিজগত বিশেষ করে আকাশ, যমিন, চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুসলমানদের নামায আদায় করা, হজ্জ্ব করা, রোযা রাখা, ক্বেবলার দিক নির্নয় করা, হত্যা নিষিদ্ধ হারাম মাসগুলোর মর্যাদা রক্ষা করা ইত্যাদি বিচিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করার সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি মুসলমানদের আগ্রহ ছিল বেশি।

অনুবাদ যুগে সবচেয়ে খ্যাতিমান জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ ছিলেন নওবাখ্‌তের খান্দানের। এই খান্দানটি পরবর্তীকালে মুসলমান হয়েছিল এবং আরো পরে শিয়া মাযহাবের অনুসরণ করেছিল। এই খান্দানটি দীর্ঘ সময় ধরে আব্বাসীয় শাসকদের দরবারে ছিল এবং তাদের মধ্য থেকে অনেক সরকারী কর্মকর্তা, অনেক বক্তা এবং বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী বেরিয়ে এসেছিল। আব্বাসীয় খলিফাদের আহ্বানে এই খান্দানের বহু বিজ্ঞ বিজ্ঞ মনীষী বিশেষ করে নওবাখ্‌ত এবং তার ছেলে আবু সাহ্‌ল গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ অনুবাদ করেন। অবশ্য তাঁরা অনুবাদ শেষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজস্ব লেখায় নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিও ব্যক্ত করতেন। নওবাখত ছাড়া অপর বিখ্যাত ইরানী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিশিষ্ট শিয়া মনীষী মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম ফাযারির নামটি অনুবাদকদের নামের তালিকায় উজ্জ্বল স্থান করে নিয়েছে। তার পিতা ইব্রাহিম প্রথম মুসলমান যিনি গ্রহ-নক্ষত্রের্উচ্চতা ও গতিবিধি নির্ণায়ক যন্ত্র এস্ট্রোলেইব থৈরি করেছিলেন। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত বইয়ের নাম হেোল ‘সেন্দ হেন্দে কাবির'। আব্বাসীয় খলিফা মামুনের শাসনকাল পর্যন্ত এই গ্রন্থটিই ছিল নক্ষত্র বিষয়ক বিদ্যার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ।

খলিফা মানসুরের বিশিষ্ট চিকিৎসক জার্জিসও গ্রিক এবং সুরিয়ানী ভাষার চিকিৎসা বিষয়ক বেশ কিছু বই অনুবাদ করেন। মানসুরের শাসনকা্েই ইরানের বিখ্যাত লেখক ইবনে মোকাফফে আরবি ভাষা থেকে সাহিত্য গ্রন্থ কালিলা ও দিমোনা অনুবাদ করেছিলেন। যুক্তিবিদ্যার অনেক বইও তিনি অনুবাদ করেছিলেন। খলিফা মানসুরের সময় থেকে বিভিন্ন ধর্মের মাঝে বাহাস বা সংলাপের সূত্রপাত হয়েছিল। সংলাপের এই ধারা মানসুরের ছেলে মাহদি আব্বাসীর সময় আরো বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। সংলাপের যুক্তিপূর্ণতার জন্যে এবং গ্রহণযোগ্যতার জন্যে মাহদির সময় এরিস্টটলের বইও অনুবাদ করা হয়েছিল। এভাবেই অনুবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামী সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।

0 comments:

Post a Comment

 
Copyright © . A-Tasauf is the holy place of Mind . - Posts · Comments
Theme Template by BTDesigner · Powered by Blogger