Saturday, May 18, 2013

মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি (১০-১৫পর্ব)


 মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতি (১০-১৫পর্ব)


আব্বাসীয় শাসনামলে বিশেষ করে খলিফা মানসুরের সময় প্রচুর শিল্পকর্ম অনুবাদ হয়েছিল। এই অনুবাদের ধারা ইসলামী সভ্যতার গঠন ও বিকাশে ব্যাপক অবদান রেখেছিল। তবে খলিফা মানসুরের সময় ছাড়াও অনুবাদের ক্ষেত্রে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছিল। আজকের পর্বে আমরা সেদিকে খানিকটা নজর দেওয়ার চেষ্টা করবো।


আব্বাসীয় পঞ্চম খলিফা হারুনুর রশিদের শাসনামলেও জ্ঞান ও বিজ্ঞানের উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে এবং বিদেশী শিল্প ও সাহিত্যকর্ম অনুবাদ করার ক্ষেত্রে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। খলিফা হারুনের মন্ত্রী ইয়াহিয়া বিন খালেদ বারমাকি গ্রিক সাহিত্য ও শিল্পকর্ম নিয়ে চর্চা, পড়ালেখা কিংবা অনুবাদকারীদেরকে ব্যাপক সাহায্য সহযোগিতা করতেন। ইয়াহিয়া কোনো একজনকে রোমান সাম্রাজ্যে পাঠিয়েছিলেন গ্রিক লিপির অনুলিপিগুলো কিনে আনার জন্যে। এরফলে গ্রিসের মূল্যবান গ্রন্থগুলো বাগদাদে আসার পথ সুগম হয়। সুরিয়ানী, ইরানী, ভারতীয় চিকিৎসক এবং বিজ্ঞ মনীষীদের বাগদাদে আসা-যাওয়ার ফলে জনসাধারণের দৃষ্টি পড়ে বিদেশী বিভিন্ন জ্ঞান, বিদ্যা, বিদেশীদের গ্রন্থ ইত্যাদির ওপর এবং সেইসাথে তারা বিদেশী শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায়ও এগিয়ে আসে। এই বিজ্ঞ মনীষীগণ আরবি ভাষার সাথে পরিচিত হবার সুবাদে জনগণের সাথে মেলামেশা করেন এবং সেই সুযোগে তাঁরা জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। ইতিহাসের অন্যান্য বিজয়ীদের আচরণের বিপরীতে মুসলিম শাসকরা বিভিন্ন শহর বা অঞ্চল বিজয় করার পর তাঁদের গ্রন্থাগারগুলোকে বাগদাদে স্থানান্তর করে যাতে মূল্যবান শিল্প ও সাহিত্যকর্মগুলোকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা যায়।


খলিফা হারুনুর রশিদ আঙ্কারা, আমরিয়া এবং রোমের অন্যান্য শহর জয় করার পর ইউনানী চিকিৎসা সংক্রান্ত তাদের বহু গ্রন্থ বাগদাদে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ওই গ্রন্থগুলোকে ইউহান্না বিন মাসভিয়া সুরিয়ানী নামের নিজস্ব এক চিকিৎসককে দিয়েছেন আরবি ভাষায় অনুবাদ করার জন্যে। হারুনের সময়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক গ্রন্থও অনূদিত হয়েছিল। নওবাখ্‌ত খান্দানের বিখ্যাত মনীষী ফায্‌ল ইবনে নওবাখ্‌ত জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বহু গ্রন্থ পাহলাভি থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। এ কারণে হারুন তার গ্রন্থাগারের দায়িত্ব তার ওপরই অর্পন করেন। মুসলিম পণ্ডিতগণ এইসব গ্রন্থের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন এবং গ্রন্থগুলোর বিষয়-প্রকরণ সম্পর্কে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত ব্যক্ত করেন। তাঁরা নিজেরাই ছিলেন সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী, সে কারণে তাঁরা নিজেরাই নতুন নতুন বই রচনায় হাত দেন।


সাসানীয় শাসনামলের একটি ঐতিহ্যবাহী স্মৃতি হলো বায়তুল হিকমাহ। সাসানীয় শাসনামলে বিভিন্ন তথ্য ও দলিল দস্তাবেজ সংরক্ষণাগার ছিল এটি। ইরানের বিভিন্ন গল্প-কাহিনী, যুদ্ধ এবং ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য এই বাইতুল হিকমায় সংরক্ষণ করা হতো। মানসুর আব্বাসীর সময় অনুবাদের ক্ষেত্রে ব্যাপক তৎপরতা ছাড়াও ঐতিহ্যবাহী এই বাইতুল হিকমাহ'কে সংরক্ষণ এবং তার বিস্তারের ব্যবস্থা করা হয়। তবে মানসুরের সময় এই স্থাপনাটিকে আব্বাসীয় প্রশাসনের একটি বিভাগ বলে মনে করা হত। সাসানীয় নিদর্শনের ভিত্তিতেই এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হয় বাগদাদে। এর দায়িত্ব ছিল সাসানীয় সঙস্কৃতি এবং ইতিহাসকে পাহলাভি ভাষা থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা এবং সেগুলোকে যত্নের সাথে রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর এই কাজের লক্ষ্যে সেখানে বহু দক্ষ দক্ষ অনুবাদককে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেইসাথে নিয়োগ দেওয়া হয় একদল দক্ষ বুক বাইন্ডার বা পুস্তক বাঁধাইকারীকে। হারুন এবং বারমাকিয়ানের শাসনামল পর্যন্ত বাইতুল হেকমার এই গুরু দায়িত্ব বা কর্মকাণ্ডগুলোটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছিল। তবে মামুনের সময় পূর্ববর্তী কার্যক্রমের পাশাপাশি বাইতুল হেকমায় নতুন কিছু কর্মসূচি বা কাযর্ক্রম যুক্ত হয়। এইসব কার্যক্রমের মধ্যে অধ্যয়ন এবং গবেষণাকর্ম উল্লেখযোগ্য। তবে গণিত এবং জোতির্বিজ্ঞানের মতো আরো বহু বিষয়ের ওপর এই কেন্দ্রে বেশি গবেষণা হতো। গ্রিক শিল্পকর্মগুলো অনুবাদ করার জন্যে বায়তুল হেকমায় উপযুক্ত পরিবেশ ছিল।


মামুনের সময় বাইতুল হিকমাহ আরো বেশি ঐশ্বর্য লাভ করে। কেননা তিনি অনুবাদ ছাড়াও বিদ্যার বিভিন্ন বিষয় বিশেষ করে দর্শনের বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। তার এই পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল মোতাযিলাদের আকিদা-বিশ্বাস এবং চিন্তাভাবনাকে আরো শক্তিশালী করে তোলা। ইবনে নাদিম তাঁর বই নির্ঘন্টে লিখেছেন এক রাতে মামুন বিখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটলকে স্বপ্নে দেখেন এবং স্বপ্নের ভেতরেই এরিস্টটলকে অনেক প্রশ্ন করেন। ঘুম ভাঙ্গার পর তাই এরিস্টটলের বইগুলো অনুবাদ করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রোমান বাদশাহকে একটি চিঠি লেখেন রোমে প্রচলিত প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে যেগুলো শ্রেষ্ঠ সে সম্পর্কে তাঁকে জানাতে। রোমের বাদশাহ মামুনের ঐ আহ্বানে সাড়া দেয় এবং মামুন বাইতুল হেকমাহ'র প্রধান সালমানসহ একদল প্রতিনিধিকে রোমে পাঠান। তারা সেখানে গিয়ে তাদের পছন্দের বিষয়বস্তুর ওপর লেখা মূল্যবান বইগুলো এনে মামুনের কাছে দেয় আর মামুন শ্রেষ্ঠ অনুবাদকদের শীর্ষস্থানীয় হুনাইন ইবনে ইসহাকের নেতৃত্বে বিশেষ করে গ্রিক দর্শন বিষয়ক মূল্যবান গ্রন্থগুলোকে অনুবাদ করার জন্যে একদল অনুবাদককে দায়িত্ব দেন।


মামুনের সময়েই গ্রিক, ভারতীয়, ইরানী এবং আরবদের ঐতিহ্যবাহী শিল্প-সাহিত্যকর্মগুলো বাইতুল হিকমায় সংগ্রহ করা হয়। এভাবেই মামুনের শাসনামলে বাইতুল হিকমা মানবীয় জ্ঞানের অনুবাদ ও স্থানান্তরের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এ সময় বায়তুল হিকমার পূর্ণতার জন্যে বাগদাদে মানমন্দিরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইতালির বিশিষ্ট লেখক নালিনুর ভাষ্য মতে, ইতিহাসে এই সময়টাই ছিল ইসলামের জন্যে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম অধ্যায়। অনেক বড়ো বড়ো আলেমে এই বাইতুল হিকমার দায়িত্ব পালন করেছেন, কাজ করেছেন, তাদেরকেই এক কথায় বাইতুল হিকমার মালিক বলে মনে করা হতো। কথিত আছে যে বাইতুল হিকমায় একেবারে প্রথম দিকে যারা যাওয়া-আসা করতেন, অনুবাদের কাজের সাথে জড়িত ছিলেন তারা ছিলেন ইরানী। তাদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হলেন সাহল বিন হারুন, সায়িদ বিন হারুন এবং সালাম বা সালমান।


সাহল বিন হারুন ছিলেন ইরানের আহওয়ায প্রদেশের মেইশান-খুযিস্তানের অধিবাসী। হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে তিনি বাগদাদে বসবাস করতেন এবং তিনি ছিলেন সমকালীন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগুণী মনীষী এবং সাহিত্যিক। সাহল আরবি ভাষা ও সাহিত্যে অনেক বড়ো পণ্ডিত ছিলেন এবং এ ভাষার একজন স্বনামধন্য লেখকও ছিলেন। মানবীয় নৈতিকতা এবং পৌরনীতি সম্পর্কে তাঁর লেখা বিখ্যাত একটি বই রয়েছে যেটি কালিলা ও দেমোনা'র স্টাইলে পশুপাখির জবানিতে রচিত হয়েছে।
সালাম বা সালমান ছিলেন অপর এক বিখ্যাত ইরানী মনীষী ও অনুবাদক যিনি বাইতুল হিকমাহ পরিচালকদের একজন ছিলেন। ফার্সি ভাষা থেকে আরবি ভাষায় বহু বই তিনি অনুবাদ করেছেন। কালিলা ও দেমোনার কিছু অংশও তিনি আরবিতে অনুবাদ করেছেন। এই মনীষী আরো ক'জন অনুবাদককে সাথে নিয়ে রোমে যান এবং রোমের বাদশার অনুমতিক্রমে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং দর্শনের মূল্যবান মূল্যবান বহু বিষয় আরবি ভাষায় অনুবাদ করে বাগদাদে নিয়ে আসেন। প্রাচীন অনেক দুর্লভ বইয়ের যেসব অনুবাদ এখন লক্ষ্য করা যায় সেগুলোর অধিকাংশই সেই অনুবাদ যুগের বিজ্ঞ অনুবাদকদের অবদান। তবে আব্বাসীয় খলিফা মুতাসেমের সময় ইসলামী হুকুমাতের কেন্দ্র বাগদাদ থেকে সরিয়ে সামেরায় নিয়ে যাবার কারণে বাইতুল হিকমার সৌকর্য ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়। পরবর্তীকালে অবশ্য মুসলমানরা আরো অনেক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেমন মামুনের অনুসরণে স্পেনের উমাইয়া খলিফা আল-মুস্তানশার বিল্লাহ বিশাল এক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। মিশরেও ফাতেমি খলিফারা বড়ো বড়ো অনেক লাইব্রেরি গড়ে তোলেন।


১১তম পর্ব
গত আসরে আমরা অনুবাদ আন্দোলন বা অনুবাদ যুগ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আব্বাসীয় শাসনামলে বিশেষ করে খলিফা মানসুরের সময় প্রচুর শিল্পকর্ম অনুবাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলাম। আসলে আব্বাসীয় শাসনামলে অনুবাদের ধারাটাকে শক্তিশালী করে তোলার লক্ষ্যে প্রতি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছিল। বাইতুল হিকমাহ স্টাডি সেন্টার তেমনি একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে অনুবাদের পাশাপাশি ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজও রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। এরি ধারাবাহিকতায় আমরা আজকের আসরে কথা বলার চেষ্টা করবো।


আব্বাসীয় খলিফা মামুনের সময় জনগণকে পড়ালেখা করা তথা জ্ঞান অর্জনের জন্যে অনুপ্রাণিত করা হয়েছিল। সেজন্যে অনুবাদের এই যুগে ডুক্তিবিদ্যা, দর্শনমহ বিভিন্ন বিষয়ের বহু লেখা অনুবাদ করার প্রয়েঅজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রয়োজনীয়তার কারণেই ইরান, ইরাক, ভারত এবং সিরিয়া থেকে অনেক অনুবাদককে বাগদাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এইসব অনুবাদক বিভিন্ন ধর্ম ও মাযাহাবের এবং বিভিন্ন বর্ণের ছিলেনঃ যেমন নেস্তুরিয়ান, জরাথ্রুস্টি, ব্রাহ্মণ, রোমি ইত্যাদি। এই অনুবাদগণ বাগদাদে গ্রিক, ফার্সি, সুরিয়ানী, হিন্দি ইত্যাদি ভাষার বই অনুবাদ করেন। লেবাননের বিশিষ্ট লেখক জর্জি জিদান এই সময়ে বাগদাদে বই বিক্রয়ের দোকান, সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চার প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।


আব্বাসীয় শাসক মানসুরের সময় নিজস্ব উদ্যোগেও অনেকেই অনুবাদকর্মে হাত দিয়েছিলেন। এই শ্রেণীর মধ্যে বনি মুসা নামে পরিচিত ইরানের বনি শাকের খান্দানের নাম উল্লেখ করা যায়। মুসা বিন শাকের এবং তার সন্তান মুহাম্মাদ, আহমাদ এবং হাসান খোরাসানের অধিবাসী ছিলেন। মুসার সন্তানেরা বায়তুল হেকমায় গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, ম্যাকানিক্স্ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পড়ালেখা করেন এবং এসব বিষয়ের ওপর ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন। এই তিন ভাই জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বহু বই লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন। তাদের বহু বই পরবর্তীকালে ইউরোপে আরবি থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর এরকম উল্লেখযোগ্য একটি বই ছিল মেকানিক বিষয়ে। বলা যায় ইসলামী যুগে মেকানিকেল বিষয়ে সর্বপ্রথম বই এটি।
তৎকালীন অপরাপর অনুবাদকদের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে মুসা খাওয়ারেযমির নাম উল্লেখ করার মতো। ইসলামী যুগের মহান এই মনীষী ছিলেন একদিকে গণিতবিদ অপরদিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ভূগোলবিদ এবং সে সময়কার নামকরা ইতিহাসবিদ। তাঁর পূর্বপুরুষগণ ছিলেন খাওয়ারেযমের অধিবাসী। এ কারণেই তিনি খাওয়ারেযমি হিসেবেই প্রসিদ্ধি পান। খাওয়ারেযমি তাঁর শৈশবে এবং শিক্ষাজীবন শেষে খলিফা মামুনের সময় দারুল হিকমার সদস্য হন। যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে বাদশা মামুন গ্রন্থাগার প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাদের একজন ছিলেন খাওয়ারেযমি। তিনি তাঁর নিজস্ব লেখালেখিতে এবং জোন্‌দি শাপুর বিদ্যালয়ে পড়ানোর সময় বিভিন্ন দেশ ও জাতির বইগুলো বিশেষ করে ইরানী এবং ভারতীয় প্রাচীন বইগুলোকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছেন।


খাওয়ারেযমি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বীজগণিত এবং সমাধান নিয়ে বই লিখেছেন। তিনি বীজগণিতকে একটি স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে গণ্য এবং প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ‘আল-জাবরা' নামে তাঁর বইটি এ বিষয়ক অনবদ্য গ্রন্থ হিসেবে আজো অবশিষ্ট রয়েছে। বীজগণিত ছাড়াও হিসাব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও খাওয়ারেযমির ব্যাপক অবদান ছিল।এ্যালগোরিদম নামে হিসাব বিজ্ঞানে যে পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয় তা খাওয়ারেযমির দেওয়া নাম। পরবর্তীকালে এই পরিভাষাটি ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় প্রবেশ করে। খাওয়ারেযমি সম্পর্কে ইতালির বিশিষ্ট মনীষী মধ্যপ্রাচ্যবিদ আলদোমেইলি তাঁর লেখা আরবের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেনঃ খাওয়ারেযমি ছিলেন সবচেয়ে বড়ো মুসলিম গণিতবিদ। তিনি কেবল মুসলিম বিশ্ব কিংবা প্রাচ্যেই নন বরং পশ্চিমা বিশ্বেও গণিতবিদ হিসেবে ব্যাপক খ্যাতিমান। গণিতশাস্ত্রে খাওয়ারেযমি নতুন এক যুগের সূচনা করেন। তাঁর লেখা বইগুলো হিসাব বিজ্ঞান, জ্যামিতি এবং ত্রিকোণমিতিতে নজিরবিহীন।


আব্বাসীয় খলিফা মামুনের পরবর্তী কালের শ্রেষ্ঠ অনুবাদকদের মাঝে সাবেত বিন কোর্‌রার নামটি উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন একজন সাবেয়ী দার্শনিক। হাররানে বসবাস করতেন, হাররান এখন তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে পড়েছে। সাবেত চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যাপক পারদর্শী ছিলেন।্এসব বিষয়ে তাঁর পারদর্শিতার নিদর্শন তাঁর লেখা বইগুলোতে সুস্পষ্ট। এগুলোর বাইরেও তিনি সুরিয়ানী ভাষায় সাবেয়ী মাযহাব সম্পর্কে বই লেখেন। তিনি সুরিয়ানী ভাষায় ব্যাপক দক্ষ ছিলেন এবং এ ভাষায় বহু বই অনুবাদও করেছিলেন। গ্রিক ভাষার বহু বই বিশেষ করে গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার বইগুলো অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা করেন।


বাগদাদে অনুবাদের এই ধারা দুই শতাব্দী পর্যন্ত ব্যাপক তোড়জোড়ের সাথে চলে। এরপর ধীরে ধীরে অনুবাদের কাজে ভাটা পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় সহস্রাব্দে এসে অনুবাদের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে অনুবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে গেছে কিংবা অনুবাদ করার মতো যোগ্য লোকের অভাব ছিল। উল্টো বরং বাগদাদে আজুদি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং ডাক্তার, অনুবাদক, বিজ্ঞানীদের সমাবেশ হিজরী চতুর্থ শতকের শেষদিকে আলে-বুইয়েরের সমকালে জ্ঞান ও বিজ্ঞানে কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে যে ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটেছে তারই পরিচয় বহন করে।


অনুবাদ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবার একটা মৌলিক কারণ হলো বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন কোনো অগ্রগতি না হওয়া। এর অর্থ এই নয় যে জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রিসের আর কোনো বই হাতের কাছে ছিল না, বরং জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের জন্যে বা লেখকদের কাঙ্ক্ষিত আর কোনো বই গ্রিক ভাষায় অবশিষ্ট ছিল না। যার ফলে অনুবাদের এই ধারা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসে। জ্ঞানের বহু শাখাতেই অনেক আগে থেকেই মূল টেক্সটগুলো পড়া, অনুবাদ করা এবং ব্যাখ্যা করা হয়ে গেছে। যার ফলে জ্ঞানের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেক বেশি বিচরণ করার সুযোগ আসে এবং নতুন নতুন মৌলিক বই বা শিল্পকর্মও তৈরি হতে থাকে। নতুন নতুন বিষয় এবং বই রচিত হবার কারণে অনুবাদের শৌকর্য ম্লান হয়ে যায় এভং নতুন নতুন বই আর বিষয় নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায়। আগে যাঁরা অনুবাদের জন্যে আগ্রহী ছিলেন তারাই এখন আরবি ভাষায় নতুন নতুন বই রচনা করার আগ্রহ দেখাতে থাকেন।


আলবুইয়ের আমলে নতুন নতুন বই লেখার চর্চা অনেক বেশি বেড়ে যায়। এভাবে নতুন বই, নতুন লেখালেখি, নতুন নতুন বিষয়-আশয়ের চর্চার কারণে অনুবাদের ধারাটির একেবারেই পরিসমাপ্তি ঘটে।


১২তম পর্ব


ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে শুরু থেকেই জ্ঞান-গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক গুরুত্ব ছিল। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সাংস্কৃতিক যে বিশাল ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে, ইসলামী সভ্যতার বিভিন্ন যুগে সেই ঐতিহ্য ব্যাপক উজ্জ্বলতা পায় বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী সভ্যতার যুগে এসে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণতা পায়। এইসব প্রতিষ্ঠান ইসলামী সমাজের মৌলিক অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো। মসজিদ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, বাইতুল হিকমা এবং লাইব্রেরির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত উন্নত, প্রশান্ত এবং স্থিতিশীল সমাজেই গড়ে ওঠে। ইসলামী সভ্যতার যুগে তাই উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় বড়ো বড়ো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং লাইব্রেরি বেশি বেশি গড়ে উঠেছে। এগুলোর এতো বেশি বিকাশ ঘটেছে যে তৎকালীন সময়ের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এইসব প্রতিষ্ঠান।
মাদ্রাসার মতো জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করার পেছনে মূল লক্ষ্যটি ছিল সাধ্যমতো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মধ্য দিয়ে ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে মুসলমান হওয়ার পথ সুগম করা। যাই হোক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হবার এই আসরে আমরা আজ চেষ্টা করবো মসজিদ, মাদ্রাসার মতো সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করার।


ইসলামী সভ্যতার অঙ্গনে ধর্মীয় কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা কেন্দ্র হিসেবে সর্বপ্রথম যে স্থাপনাটির নাম উঠে আসবে তা হলো মসজিদ। মসজিদই মুসলমানদের জন্যে সর্বপ্রথম কোনো ধর্মীয় কেন্দ্র। রাসূলে আকরাম (সা) মানুষের কাছে তাঁর মুক্তির বাণী পৌছিয়েঁ দেওয়ার লক্ষ্যে এবং তাদেরকে সরল সঠিক পুণ্যের পথে পরিচালিত করার লক্ষ্যে দাওয়াতী কাজের কেন্দ্র হিসেবে মদিনায় সর্বপ্রথম যে মসজিদটি স্থাপনন করেছিলেন, দাওয়াতী কাজের সম্প্রসারণের সাথে সাথে মসজিদ নির্মাণের সেই ধারাও ধীরে ধীরে বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। মদিনায় প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম মসজিদটি ছিল শিক্ষা-প্রশিক্ষণ, দ্বীনী প্রচার, বিচার-আচারসহ সাংস্কৃতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক সকল কর্মকান্ডের মূল কেন্দ্র। নবীজীর পর হযরত আলী (আ) ও তাঁর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে নবীজীর প্রদর্শিত পন্থাই অনুসরণ করেন। সে কারণেই সেই সময়েও জ্ঞান এবং শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডগুলো মসজিদ কেন্দ্রিক পরিচালিত হতো। জ্ঞানের বিভিন্ন রকম আসরে তিনি ইসলাম পরিচিতি বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতেন এবং জ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন সংলাপ বা বাহাসেও অংশগ্রহণ করতেন।
হযরত আলী (আ)-এর শাহাদাতের পরও আহলে বাইতের মাধ্যমে ঐ ধারা অভ্যাহত থাকে। তারি ধারাবাহিকতায় ধীরে ধীরে বাগদাদসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মাদ্রাসা, বাইতুল হিকমাহ এবং লাইব্রেরির মতো বিচিত্র প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা গড়ে ওঠে। ইমাম সাদেক (আ) এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি গবেষণা ও সংলাপমূলক কর্মকাণ্ডও পরিচালিত হতো। ইমাম তাঁর প্রত্যেক ছাত্রের জন্যে একেকটি বিষয় সুনির্দিষ্ট করে দিতেন যে বিষয়ের ওপর ঐ ছাত্রকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হতো এবং প্রশ্নকারীদের প্রশ্নের সমাধান দিতে হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অবন বিন তাগলাব ফিকাহ বা ইসলামী আইনশাস্ত্রে ব্যাপক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। ইমাম তাকে বললেন, তুমি মসজিদে গিয়ে বসো এবং ফতোয়া দাও। ফতোয়া মানে হলো জীবনের বিভিন্ন সমস্যার ইসলামী আইন ভিত্তিক সমাধান। হিশাম বিন হাকাম ছিলেন কালাম শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তিনি মসজিদে ইমামত, আকায়েদ নীতি সম্পর্কে বাহাস এবং সংলাপে অংশ নিতেন। ইমামের আরেক শাগরেদের নাম ছিল জাবের ইবনে হাইয়্যান। তিনি ছিলেন রসায়ন শাস্ত্রসহ আরো অনেক শাস্ত্রে বিজ্ঞ। মসজিদে তিনি সেইসব বিষয়ে পড়াতেন। স্বয়ং ইমাম সাদেক (আ) ছিলেন জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক পারদর্শী।
কথিত আছে যে, ইমাম জাফর (আ) ছিলেন জাফরি শিয়া মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। মদিনায় তাঁর মক্তবে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান আহরণের উদ্দেশ্যে আসতেন। চার হাজারেরও বেশি মানুষ ফিকাহসহ ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্যে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করেন। ইমাম সাদেক (আ) এর পাঠ দানের জলসা বা ক্লাসগুলো সাধারণত মসজিদেই অনুষ্ঠিত হতো। তাঁর ছাত্ররাও বেশিরভাগ ক্লাসই মসজিদে নিতেন, মসজিদে সবাই বৃত্ত রচনা করে বসতেন আর ইমামের ছাত্ররা সেখানে দারস দিতেন।


মসজিদ ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক কেন্দ্র হিসেবে সর্বপ্রথম স্থাপনা। মাদ্রাসার প্রচলন হয় মসজিদের পরে। অবশ্য মাদ্রাসার স্থাপত্য কার্যক্রমও অনেকটা মসজিদের মতোই ছিলো। মসজিদে যেমন জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হতো, মাদ্রাসাগুলোতেও তা-ই হতো। তবে মাদ্রাসার ব্যাপক বিকাশ সত্ত্বেও মসজিদের সেই প্রশিক্ষণমূলক ভূমিকা কিন্তু অক্ষুন্নই ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরানের সিস্তানে হিজরী প্রথম শতকে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। ঐ মসজিদে বছরের পর বছর ধরে ধর্মীয় বিষয় আশয় শিক্ষা দেওয়া হতো। বোখারাতেও বেশ কয়েকটি মসজিদ দ্বীনী শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহৃত হতো। খোরাসানের শিক্ষা ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র নিশাবুরে বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। মাতারযি মসজিদ, আকিল মসজিদ এবং প্রাচীন মসজিদ এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই মসজিদগুলোকেও শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যবহার করা হতো।


ইসলামী শহরগুলোতে সেই শুরু থেকেই বহু মসজিদ নির্মিত হয়েছে যেগুলোতে লাইব্রেরি ছিল। এরকম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের নাম করা যেতে পারে, যেমনঃ আল-আকসা মসজিদ, জামে উমাইয়া দামেশ্ক, তিউনিশিয়ার জামেউল কাবির, কায়রোর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। ইসলামী সভ্যতার ই্তিহাসে এইসব প্রতিষ্ঠান বেশ খ্যাতিময়। এসব প্রতিষ্ঠানে বিশাল বিশাল গ্রন্থাগার ছিল। বিভিন্ন পবিত্র স্থান বা স্থাপনাতেও বড়ো বড়ো গ্রন্থাগার ছিল। যেমন মাসজিদুল হারাম বা হারামে মাক্কি, মদীনার হারামে নববী, নাজাফের হারামে ইমাম আলী, কাজেমাইনের হারামে মূসা ইবনে জাফর, মাশহাদের ইমাম রেযা (আ) এর মাযার ইত্যাদি স্থাপনায় বড়ো বড়ো গ্রন্থাগার ছিল এবং এখনো আছে। এগুলো ছাড়াও বড়ো বড়ো মাযারগুলোতে যেমন কাউনিয়ায় মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির মাযার, তাব্রিযে গাযান খানের মাযার, তোরবাত জামে শেখ আহমাদ জামের মাযার ইত্যঅদিতেও বড়ো বড়ো লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল। একইভাবে সরাইখানা বা পান্থশালা, খানকাহ কিংবা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল।


ইসলামী সভ্যতা ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ আরো কিছু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যঅদির নাম করা যায়। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ক গবেষণাও করা হতো। সেজন্যে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে গড়ে উঠতো বড়ো বড়ো বইয়ের লাইব্রেরি। এরকম কয়েকটি হাসপাতালের মধ্যে মিশরের কুসাত হাসপাতাল, কায়রোর আলকাবির মানসুরি হাসপাতাল, বাগদাদের মোক্তাদেরি হাসপাতাল এবং রেই হাসপাতালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো ইসলামী সভ্যতা ও ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। ইরাক, সিরিয়া এবং মিশরসহ মুলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শত শত মাদ্রাসা গড়ে উঠেছিলো। আর লাইব্রেরি ছাড়া কোনো মাদ্রাসার অস্তিত্ব কল্পনাই করা যেত না। মাদ্রাসা এবং লাইব্রেরি পরস্পরে অঙ্গাঙ্গিভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, পবিত্র স্থান ইত্যাদির বাইরেও স্বতন্ত্রভাবে বহু লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল।


১৩তম পর্ব


ইসলামী সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশে জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গণগ্রন্থাগারগুলোর ব্যাপক ভূমিকা ছিল। এগুলোকে তখন ‘দারুল এল্‌ম' বলে অভিহিত করা হতো। হিজরী চতুর্থ শতকে দারুল এলমগুলোর প্রতিষ্ঠা শুরু হতে থাকে। এগুলোই ছিল প্রাথমিক পর্যায়ের গ্রন্থাগার। ইসলামের আবির্ভাবের পর জ্ঞানের বিকাশের প্রয়োজণীয়তা দেখা দেয় কেননা ইসলাম হচ্ছে জ্ঞান ভিত্তিক একটি ধর্ম। তারই প্রয়োজনে লাইব্রেরিগুলো গড়ে ওঠে। লাইব্রেরি মানেই হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। ফাতেমিয়ান দারুল এলমটিও তেমনি একটি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। হিজরী ৩৯৫ সালে কায়রোতে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। এখানে গণিতসহ প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দেওয়া হতো। এখানে একটি লাইব্রেরিও ছিল যাতে দশ লাখেরও বেশি বই ছিল। মোসেল দারুল এলমটিও ছিল আরো একটি বিখ্যাত লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিটিতে জ্ঞানের প্রায় সকল বিষয়েরই বইয়ের সংগ্রহ ছিল। ত্রিপলি দারুল এলম, বাগদাদ দারুল এলম, বায়তুল মোকাদ্দাস দারুল এলম প্রভৃতিও মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে স্বনামখ্যাত ছিল। এসব দারুল এলমের প্রত্যেকটিতেই হাজার হাজার বইয়ের সংগ্রহ ছিল। যার ফলে বহু গবেষক, লেখক এসব প্রতিষ্ঠানে এসে গবেষণা করতেন, লেখালেখি করতেন।


দারুল এলমের পাশাপাশি আরো এক ধরনের জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো,এগুলো নেজামিয়া নামে পরিচিত ছিল। হিজরী পঞ্চম শতাব্দিতে সেলজুকি শাসনামলের মন্ত্রী খাজা নিযামুল মুলক বাগদাদ এবং নিশাবুরসহ আরো অনেক শহরে নিজামিয়া নামে অসংখ্য মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। এইসব নেজামিয়া বর্তমান যুগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলেই গড়ে তোলা হয়েছিল। এইসব নেজামিয়া স্থাপনের মধ্য দিয়ে ইসলামী সভ্যতায় উচ্চ শিক্ষাকে উন্নত পর্যায়ে বা পূর্ণতায় পৌঁছার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। হিজরী ৪৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাগদাদ নেজামিয়াটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ নেজামিয়াগুলোর একটি। আবু ইসহাক শিরাজির মতো মহান মনীষী এখানে পাঠদান করতেন। এক সময় গাযযালির মতো মুসলিম দার্শনিকও এই বিশ্ববিধ্যালয়ে ছাত্রদের ক্লাস নেন এবং তারপর থেকে মুসলিম বিশ্বে এ ধরনের মাদ্রাসা বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।


বাগদাদ নেজামিয়ার গ্রন্থাগার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম গ্রন্থাগার ছিল এবং যশ-খ্যাতি ও সমৃদ্ধির দিক থেকে এই গ্রন্থাগারটির গর্ব করার মতো সংক্ষিপ্ত একটি দিনপঞ্জী বা ইতিহাসও রয়েছে। নিজামুল মুলক এই গ্রন্থাগারগুলো নির্মাণ করেছেন এভং তিনি নিজেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি বা দেখাশোনা করতেন। তিনি বাগদাদ নেজামিয়াটি পরিদর্শন করতে গিয়ে ছোট্ট একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। সুখের বিষয় হচ্ছে এই গ্রন্থাগারটির পরিচালনা কিংবা প্রশাসনিক কার্যক্রম সংক্রান্ত ইতিহাসের অংশবিশেষ এখনো সংরক্ষিত আছে। সেলজুকি শাসনামলে বিশেষ করে নিযামুল মুলকের আদেশে এইসব নেজামিয়া বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণে জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চার এইসব প্রতিষ্ঠান নেজামিয়া নামে পরিচিতি ও খ্যাতি পায়। বাগদাদ নেজামিয়াতে শিক্ষকদের বাসভবন ছাড়াও মসজিদ এবং গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা ছিল। যারফলে একটা বিশাল অঙ্গন জুড়ে গড়ে উঠতো নেজামিয়াগুলো। এখানে তাই ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিও বিশেষ করে ওয়াজের মজলিশ, ধর্মীয় বিষয়-আশয় নিয়ে যুক্তি-তর্কের আসর ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। এসবের কারণে বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী মনীষীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল নেজামিয়াগুলো।


ধর্মীয় ব্যাপারে ভীষণ আকর্ষণ বোধ করতেন বলে তিনি একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাগদাদের দারুল খোলাফাকে ধর্মীয় বিশ্বাস বিষয়ক মত বিনিময় কেন্দ্রে পরিণত করবেন। তাই তিনি বাগদাদ নেজামিয়াকে মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। এগুলোর পাশাপাশি খোরাসান এবং ইরাকের বিভিন্ন শহরেও অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বাগদাদ নেজামিয়া প্রতিষ্ঠালগ্নে শাফেয়ি ফিকাহ, হাদিস এবং কোরআন অধ্যয়ন ইত্যাদি বিষয়ই ছিল সেখানকার পাঠ্যতালিকায়। পরে ধীরে ধীরে তার সাথে যুক্ত হয় উসুলে ফিকা, তাফসির, কোরআন শিক্ষা, এলমে কালাম, গণিত, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্যসহ আরো অনেক বিষয়। খাজা নিযামুল মুলকের উপদেশ নামক গ্রন্থের লেখক বাগদাদ নেজামিয়ায় যেসব মহান মনীষীগণ শিক্ষকতা করেছেন তাঁদের ৮৫ জনের নামের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কয়েকজন বিখ্যাত শিক্ষকের নাম উল্লেখ করা যায় যেমনঃ আবু আব্দুল্লাহ তাবারি, আবু হামেদ মোহাম্মাদ গাযযালি এবং আবু মুহাম্মাদ খাওয়ারেযমি।


নিশাবুর শহরের ওপর সেলজুকি বাদশা খাজা নিযামুল মুলকের বিশেষ দৃষ্টি থাকার কারণে এই শহরটিও জ্ঞান ও বিজ্ঞানে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করে। বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম, ইমাম মোয়াফফাক নিশাবুরি, ইমামুল হারামাইন জুয়িনি, আত্তার নিশাবুরি প্রমুখের মতো জগদ্বিখ্যাত মনীষীগণ এই নিশাবুরেই গড়ে ওঠেন। অসংখ্য মনীষী থাকার কারণে এই নিশাবুরেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি নেজামিয়া। এই নিজামিয়াতেও অসংখ্য স্বনামধন্য মনীষী শিক্ষকতার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। মানের দিক থেকে নিশাবুর নেজামিয়াটিকে বাগদাদের পরই স্থান দেওয়া হয়। ইস্ফাহান নিজামিয়াও খাযা নিযামুল মুলকেরই নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়েও অনেক নামকরা জ্ঞানী গুণী মনীষী শিক্ষকতা করেছেন। যাদেঁর মধ্যে আবু বকর মোঃ বিন সাবেত খোজান্দি এবং ফখরুদ্দিন আবুল মায়ালি ভেরকানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার এই মহান প্রতিষ্ঠানটির কারণে ইস্ফাহান অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছিল।


বালখ নেজামিয়াটিতেও আদম বিন আসাদ সোহরাওয়ার্দির মতো শিক্ষক এবং রাশিদ ভাতভতের মতো ছাত্র থাকায় প্রতিষ্ঠানটি বেশ নাম করেছিল। বসরা নেজামিয়াও কম খ্যাতিময় ছিল না। বসরা নেজামিয়া নামের বিশ্ববিদ্যালয়টি বাগদাদ নেজামিয়ার চেয়েও বড়ো এবং বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য তা ধ্বংস হয়ে যায় এবং একই নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠান বসরার উত্তরাঞ্চলে গড়ে ওঠে। অনরূপ একটি বিশ্ববিদ্যালয় বায়তুল মোকাদ্দাসে গড়ে তুলেছিলেন সালাউদ্দিন আইয়ুবী।্এভাবে মুসলিম ভূখণ্ডের পূর্বাঞ্চলে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ধারা অব্যাহত থাকে। দজলার তীরে বাগদাদের মোস্তানসারিয়া মাদ্রাসা, মধ্য্এশিয়ার মাদ্রাসার মধ্যে সমরকন্দ্ মাদ্রাসার নাম উল্লেখ করার মতো। সাফাভি বাদশাদের আদেশেও আরো কয়েকটি মাদ্রাসা গড়ে ওঠে। যেমন ইস্ফাহানের চাহারবাগ মাদ্রাসা এবং শিরাযের খান মাদ্রাসা। এখানে ইরানের বিখ্যাত দার্শনিক মোল্লা সাদরাও শিক্ষকতা করেছিলেন। মধ্য যুগের শুরু থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ধারা আরো বেশি গতিময় হয়ে ওঠে।


এগারশ' বছর আগে মরক্কোর ফাস শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় কারভিন মাদ্রাসা। এটি সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। কায়রোর আলআজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটিও এই তালিকার অগ্রভাগে উঠে আসবে। কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠানটি তার প্রথম সহস্র বার্ষিকী উদযাপন করেছে। ইরাকের নাজাফে হিজরী পঞ্চম শতাব্দিতে গড়ে উঠেছিল ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্র। এটি এখনো তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এভাবেই ইসলামী সভ্যতা বিকাশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা পালন করে এসেছে।


১৪তম পর্ব
পশ্চিমা অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন জ্ঞান এবং আধ্যাত্মিকতার বিকাশে মুসলমানদের সবচেয়ে বড়ো অবদান হচ্ছে এসবের রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং গ্রিক যুগ থেকে রেনেসাসেঁর যুগে এই জ্ঞানকে স্থানান্তর করার মধ্যে। কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে হবে মুসলমানরা কেবল মানব জ্ঞানের সম্পদকে রক্ষাই করে নি বরং এসবের পাশাপাশি নতুন নতুন অনেক কিছু উদ্ভাবনও করেছেন, এগুলোকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌছিয়েঁও দিয়েছেন। অন্তত ছয় শতাব্দি ধরে মুসলিম মনীষীরা ছিলেন জ্ঞান ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বণোর্জ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আলো বিকিরণকারী। অথচ সেই সময় ইউরোপে জ্ঞানীদের কণ্ঠ রোধ করে ফেলা হতো। মধ্যযুগে গীর্যাগুলো চিন্তাশীল মনীষী, জ্ঞানী-গুণী, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল। তারা এইসব মহান ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে বিচারালয়ও স্থাপন করেছিল। এভাবেই গির্যাপন্থীরা জ্ঞান বিকাশের পথে এবং জ্ঞানের জগতে নতুন নতুন উদ্ভাবনীর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সেইসাথে দার্শনিক এবং পণ্ডিতজনদের ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করে অপমান অপদস্থ পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু শ্বাশ্বত ও পবিত্র ধর্ম ইসলাম সেই সূচনা লগ্ন থেকেই মুসলমানদেরকে জ্ঞান অর্জনের জন্যে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে এসেছে।


কেননা নবী করিম (সা) জ্ঞান অর্জনকে মুসলমানদের ওপর ফরয অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছেন, এমনকি জ্ঞান অর্জনের জন্যে প্রয়োজন হলে দেশের বাইরে দূর দূরান্তেও যেতে বলেছেন। একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বিভিন্ন জ্ঞান বিশেষ করে চিকিৎসাবিদ্যা এবং গণিতবিদ্যার মতো জ্ঞানগুলো গ্রিস থেকে মুসলিশ বিশ্বে প্রবেশ করে নি। বরং এইসব বিদ্যা বা শাস্ত্র মুসলমান মনীষীগণ নিজেরাই আবিষ্কার করেছেন। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন জালিনুসের চিকিৎসা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি এবং টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিগুলোই কেবল মুসলমানরা অর্জন করেছে। অথচ ইসলামী সভ্যতা নিয়ে গভীর গবেষণায় দেখা গেছে মুসলমান মনীষীগণ এসবের বাইরেও অনেক অনেক ক্ষেত্রেই গবেষণা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী সভ্যতায় এমন সব কার্যক্রম বা উপাদান রয়েছে যেগুলো মুসলমানদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। হিজরী প্রথম ছয় শতাব্দিতে শক্তিশালী এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যেগুলো বিচিত্র দার্শনিক চিন্তার রসদ জুগিয়েছে এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হবার প্রেরণা জুগিয়েছে।


এগুলো ছাড়াও বিদ্যা বা জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে মুসলিম লেখকদের লেখালেখির প্রবণতা এবং বায়তুল হিকমার মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির কারণে মুসলমানরা প্রকৃতি বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছে। চিকিৎসাবিদ্যা, নক্ষত্র বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা এবং মেকানিক্‌স প্রভৃতির মতো জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমনসব তথ্যপঞ্জী পাওয়া যায়, যেগুলোকে সামনে রেখে ঐসব বিদ্যাকে গ্রিক বলে মেনে নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না।


ইসলামী সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হচ্ছে, জ্ঞানের শ্রেণীবিন্যাস করা। ইসলামী সভ্যতার উত্থান-পতন নিয়ে পর্যালোচনা করার জন্যে জ্ঞানের এই শ্রেণীবিন্যাস খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। বিজ্ঞ মনীষীগণ জ্ঞানকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে শ্রেণীবিন্যাস করেছেন। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে মুসলিম মনীষী অবদান রেখেছেন তিনি হলেন আবু নাস্‌র ফারাবি। এহসাউল উলুম নামে তাঁর বইটি প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের জ্ঞানীজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই বইটির গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রভাব কতটুকু পড়েছিলো তা বোঝা যাবে পরবর্তীকালে লেখা অন্যান্য বইতে। ফারাবি অবশ্য তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেই ঐ স্তর বিন্যাস করেছেন।


ফারাবির পর এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ ইউসুফ খাওয়ারেযমি। তিনি তাঁর লেখা মাফাতিহুল উলুম গ্রন্থে জ্ঞানের শ্রেণীবিন্যাসের নতুন একটি পদ্ধতি উপস্থাপন করেছেন। তিনি জ্ঞানকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। একটি হচ্ছে ইসলামী জ্ঞান এভং অপরটি হলো মানবীয় জ্ঞান। মানবীয় জ্ঞান বিভাগে রয়েছে দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসা এবং রসায়ন শাস্ত্রের মতো বিষয়গুলো। ইসলামী সভ্যতা বিস্তারে যে বিদ্যাটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে তা হচ্ছে হিসাব বা গণিতবিদ্যা। ইসলামী যুগের প্রাথমিক পর্যায়ে আরবরা হিসাব শেখার প্রতি তেমন একটা আগ্রহ দেখাত না। কারণ হলো সেযুগে যারা আয়কর সংগ্রহ করতো তারা হিসাব নিকাশের দায়িত্বটাও পালন করতো,আর এইসব কর্মকর্তা সাধারণত দায়িত্বশীল শ্রেণী থেকেই নির্বাচন করা হতো। তবে নগরবাসীদের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পেলো তখন হিসাব বিজ্ঞান এবং গণিত শিক্ষার প্রয়োজণীয়তা আগের তুলনায় অনেক অনুভূত হলো।


এ জন্যেই জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো হিসাব বিজ্ঞানও আরবি ভাষায় অনূদিত হতে লাগলো। তারপর থেকেই জ্ঞান পিপাসুরা গণিত এভং হিসাব বিজ্ঞান শিখতে শুরু করে। এভাবে গণিত বিদ্যার মধ্য দিয়ে হিন্দি সংখ্যা পাশ্চাত্যে গিয়েছিল। গ্রিক গণিতে সংখ্যা লেখায় চল্লিশটি চিহ্ন ব্যবহৃত হতো। কিন্তু হিন্দী সংখ্যায় মাত্র দশটি চিহ্ন ব্যবহৃত হতো যা একেবারেই সহজ। হিন্দি সংখ্যা চিহ্নগুলো ছিল মুসলমানদের আবিষ্কার। আর এই সহজ সংখ্যা চিহ্নগুলোই পশ্চিমারা আয়ত্ত করেছিল। মুহাম্মাদ ইবনে মূসা খাওয়ারেযমি ছিলেন অপর এক ইরানী মুসলিম মনীষী। তিনি গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং ভূগোলের মতো বিভিন্ন বিষয়ে নামকরা পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনিই হিন্দি সংখ্যা লিখন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে বই লিখেছিলেন এবং মুসলিম বিশ্বে তার প্রসার ঘটিয়েছেন। খাওয়ারিযমির বইটিই সম্ভবত হিসাব বা গণিত সংক্রান্ত সর্বপ্রাচীন বই যা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে আদৃত হয়। অ্যালজেবরা বা বীজগণিত আবিষ্কারের জন্যেও খাওয়ারেযমি খ্যাতিমান ছিলেন। তিনি আলজাব্‌র ওয়াল মোকাবেলা নামে যে বিখ্যাত গ্রন্থটি রচনা করেন ঐ গ্রন্থটির নাম অনুসরণে ইউরোপীয়রা এই গণিতবিদ্যার নামকরণ করেছেন অ্যালজেবরা।


বিশিষ্ট মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন লিখেছেন, মধ্যযুগে ্উরোপীয়রা বীজগণিত ও সমাধানকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ধারণ করে। ফ্রান্সিস ভিয়েতের সময় পর্যন্ত ইউরোপে জ্ঞান চর্চার ভিত্তিই ছিল অ্যালজেবরা। এলগো রিদম নামে যে পরিভাষাটি হিসাব বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বহুল পরিচিত এবং ব্যবহৃত, তা খাওয়ারেযমির দেওয়া নাম থেকেই ইউেোপীয় ভাষাগুলোতে প্রবেশ করেছে। ইবনে নাদিম তাঁর নির্ঘন্ট বইতে খাওয়ারেযমির দুটি অ্যাস্টরেোনমিকেল চার্টের কথা উল্লেখ করেছেন। খাওয়ারেমির এই অ্যাসট্রোনমিকেল চার্ট ইসলামী যুগের প্রথম গ্রন্থ যাতে কেবল ত্রিকোণামিতির কথাই বলা হয় নি, বরং এই গ্রন্থের ভূমিকায় জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে।


১৫তম পর্ব
গণিতশাস্ত্রে বিখ্যাত আরো একজন মুসলিম মনীষী ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তিনি হচ্ছেন ইব্রাহিম ওকলিদেসি। খাওয়ারেযমির পর গণিতশাস্ত্রে তিনি নতুন নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করেন। ডেসিমলস বা দশমাংশের মাধ্যমে ভগ্নাংশের যে হিসাব গণিতশাস্ত্রে ব্যবহৃত হয় ওকলিদেসি তা উদ্ভাবন করেছিলেন। দামেশকের অধিবাসী এই গণিতবিদ তাঁর এই তত্ত্ব হিন্দি হিসাব নামক নিজস্ব বইতে তুলে ধরেন। অবশ্য জীবিতাবস্থায় তিনি তাঁর এই বইয়ের প্রতি কিংবা তাঁর দেওয়া থিউরির প্রতি গণিত চর্চাকারীদের আকর্ষণ বোধ করার বিষয়টি দেখে যেতে পারেন নি। তবে তাঁর মৃত্যুর প্রায় ৫০০ বছর পর গিয়াস উদ্দিন জামশিদ কাশানির মাধ্যমে ওকলিদেসির তত্ত্ব বা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পুনরায় সবার সামনে উঠে আসে।


মুসলিম গণিতবিদরাই সর্বপ্রথম অ্যালজেবরাকে জ্যামিতির ভেতর প্রবেশ করান এবং বীজগণিতের সমীকরণের মাধ্যমে জ্যামিতির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। মূসা বিন শাকের হিজরী তৃতীয় শতাব্দির একজন মনীষী ছিলেন। বিখ্যাত এই মনীষী ছিলেন মুসলমান এবং ইরানের অধিবাসী। তিনি এবং তাঁর সন্তানেরা জ্যামিতি এবং গণিতের ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। এইসব গবেষণামূলক কাজগুলোকে পরবর্তীকালে পশ্চিমা পন্ডিতেরা অনুবাদ করেছেন এবং সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছেন।মূসার সন্তান বানু মূসা বৃত্তের পরিধি বা আয়তন মাপার জন্যে তুলনামূলকভাবে নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বৃত্তের ব্যাস বা ঘনত্ব পরিমাপের ক্ষেত্রে কিংবা জ্যামিতিক গঠনের পরিমাপ করার জন্যেও তিনি ব্যাপক অবদান রেখেছেন।


ইসলামী যুগে গণিতশাস্ত্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এরকম আরো একজন গণিতবিদ হলেন আবুল হাসান সাবেন বিন কুররা। তিনি ছিলেন হাররানের অধিবাসী। ২১১ হিজরীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সুরিয়ানী ভাষায় কথাবার্তা বললেও তিনি গ্রিক এবং আরবি ভাষায় ব্যাপক দক্ষ ছিলেন। গণিতশাস্ত্রে তিনি যেসব অবদান রেখেছেন সেগুলো পরবর্তীকালে এক্ষেত্রে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, নতুন নতুন থিওরি আবিষ্কার করেছেন তাদেরকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছে, পথের নির্দেশনা দিয়েছে। জ্যামিতি এবং গণিতবিজ্ঞানে বিশেষ করে তিনি বিভিন্ন গঠনের বাইরের আকৃতি পরিমাপ করার চমৎকার সব পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। তাঁর বইগুলোতে অর্থাৎ নিজের লেখাতে যেমন তেমনি গ্রিক গণিতবিদদের যেসব বই তিনি আরবি ভাষায় অনুবাদ করেছেন সেগুলোতেও তাঁর সেইসব পদ্ধতির বর্ণনা রয়েছে।


অপর এক মুসলিম গণিতবিদ হলেন আবু সাইদ সেজযি। গণিত শাস্ত্রের উন্নয়ন ও বিকাশে তিনিও ব্যাপক অবদান রেখেছেন। আবু সাইদ সেজযি ছিলেন সিস্তানের অধিবাসী। তিনি হিজরী চতুর্থ শতকের গণিতবিদ ছিলেন এবং আবু রায়হান বিরুনির সমসাময়িক ছিলেন তিনি। বিশেষ করে জ্যামিতিতে তিনি ব্যাপক দক্ষ ছিলেন। স্বয়ং বিরুনি তাঁর লেখায় আবু সাইদ সেজযির নাম উল্লেখ করতে ভোলেন নি। আবু সাইদ সেজযি জ্যামিতির সমস্যাকে সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে সমাধান করেছেন। তিনি অন্তত ৪৫টি বই লিখেছেন এবং অসংখ্য ছোটো পুস্তিকা লিখেছেন যার মধ্যে প্রায় ৩৪টি বই-ই গণিতশাস্ত্র বিষয়ক। বাকি বইগুলো জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক।


বর্তমান বিশ্বে মুসলিম মনীষী আবু রেইহান বিরুনির নামটি সবার কাছেই মোটামুটি পরিচিত। ইরানী এই মহান মনীষীর জীবনকাল ছিল হিজরী চতুর্থ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধ। ৩৬২ হিজরীতে তিনি খাওয়ারেযমশাহীদের রাজধানী শহর তাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অত্যন্ত উঁচু মাপের এই লেখক প্রচুর বই লিখে গেছেন। ভূগোল, নক্ষত্র ও গণিতশাস্ত্রের ওপরই তিনি বেশি লিখেছেন। অনুবাদ এভং মূল রচনা মিলে ১৮০ টিরও বেশি বই তিনি লিখেছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়টি হচেছ আরবি থেকে ল্যাটিনে অনুবাদের ক্ষেত্রে তাঁর বইগুলো অনূদিত হয় নি। বিরুনির বিখ্যাত একটি বই হচ্ছে আততাফহিম। অ্যালজেবরা, জ্যামিতি এবং হিসাব বিজ্ঞানের ওপর লেখা এ বইটি। ত্রিকোণামিতির ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যাপক অবদান রয়েছে।


ইসলামী যুগের গণিতবিদদের উদ্ভাবনী ও অর্জনগুলোই গণিত শাস্ত্রের উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করা হয়। তবে বিখ্যাত মনীষীদের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষ করে গণিতশাস্ত্রে যাঁর নামটি সর্বাধিক উচ্চারিত হয় তিনি হলেন ইবনে সিনা। আবু আলি সিনা দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। হিজরী ৩৭০ সালে বোখারার কাছে-বর্তমান উজবেকিস্তানের কাছে-জন্মগ্রহণ করেন। বোখারাতে তিনি যুক্তবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা এবং গণিতশাস্ত্র পড়েন। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তিনি নুহ ইবনে মানসুর সামানীর চিকিৎসা করেন। আবু আলী সিনা ব্যাপক খ্যাতি অর্জনের পর মানসুর সামানীর রাজকীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশ করার অনুমতি পান। ইবনে সিনা আবু রেইহান বিরুনির মেো কিংবা আবু নাসর ইরাকির মতো মনীষীদের সাথে গণিতশাস্ত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে মত-বিনিময় করেন, গঠনমূলক বিতর্কও করেন।


মুসলিম এই মহান মনীষী বিশ্ববাসীর জন্যে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই রচনা করে গেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যারা পড়ালেখা করেন কিংবা চর্চা করেন তাদের জন্যে অবশ্যপাঠ্য মূল্যবান অনেক গ্রন্থ রয়েছে তাঁর। শাফা তাঁর বিখ্যাত আরো একটি বই। এ বইতে গণিত ছাড়াও মিউজিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আলোচনা রয়েছে। সংখ্যাতত্ত্ব নিয়েও এ বইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। মুসলিম মনীষীদের মধ্য থেকে আরো যাঁরা গণিত শাসতে্রে অবদান রেখেছেন তাদের মাঝে খাই্য়্যম নিশাবুরির নামটি অবশ্যই উল্লেযেোগ্য। ওমর খৈয়াম নামেই তিনি বেশি পরিচিত। হিজরী পঞ্চম শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধ এবং ষষ্ঠ শতাব্দির প্রথমার্ধের সবচেয়ে বড়ো গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন ওমর খৈয়াম। মহাজ্ঞানী এই মনীষী সমগ্র ইরানী জাতির গর্ব। বীজগণিত ও সমাধান বিষয়ে তাঁর লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিসাব বিজ্ঞানও তাঁর আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে।


আরো যেসব মুসলিম মনীষীর নাম এক্ষেত্রে উল্লেখেোগ্য তাদের মধ্যে খাজা নাসিরুদ্দিন তুসির নামটি অবশ্যই উঠে আসবে। গণিত বিষয়ের পণ্ডিত হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতিমান ছিলেন। ইরানের তূস শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গণিত ছাড়াও ইসলামী বিধি-বিধান এবং সাহিত্য বিষয়ের পাঠ তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। তূসের বিখ্যাত ফকিহ এবং মুহাদ্দিস হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। ছোটোবেলায় তিনি নিশাবুরে যান এবং প্রফেসর কামালুদ্দিনের কাছে গণিত শেখেন। ৬৫৭ হিজরীতে মারা'গেতে তিনি যে মানমন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন দেশ এবং জাতির জন্যে তা ছিল খাজা নাসিরুদ্দিন তূসির অনন্য এক অবদান। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গ্রন্থাগারও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই। অবশেষে ৬৭২ হিজরীর ১৮ই জিলহজ্বে বর্তমান ইরাকে অবস্থিত কাজেমাইনে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

0 comments:

Post a Comment

 
Copyright © . A-Tasauf is the holy place of Mind . - Posts · Comments
Theme Template by BTDesigner · Powered by Blogger